শাহীন খন্দকার: আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও নারীদের সারাবেলা একটা দিন ৷ সারা বছরের সেই সারাদিনের এক দিনের জন্য হলেও, আমরা স্মরণ করি বিশ্বের অগণিত নারীকে যারা কখনও বিরাঙ্গনা, কখনও বা মোনালিসার রূপে কোমল, কখনও একুশ শতকের একজন অতি সাধারণ নারী৷
বিশ্বে এখনও এমন বহু নারী আছেন, যারা ধরেই নেন, তাদের জন্ম হয়েছে পরের সেবা করার জন্য৷কন্যা-জায়া-জননী রূপে তারা সৃষ্টির প্রথম লগ্ন থেকে আমাদের সেবা করেছেন, আপন করেছেন৷ সেই নারীকে বারে বারেই বঞ্চিত করেছে সমাজ, রাষ্ট্র, এমনকি পরিবারও৷ নারী স্বাধীনতার টেউ এখনও পৌঁছোয়নি বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে৷ আর পৌঁছোলেও, তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থেকে গেছে শুধু কাগজে-কলমে৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহা-পরিচালক (প্রশাসন) ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী বিশ্বের মোট ১০০ কোটি মানুষের দুই-তৃতীয়াংশই নারী৷ যে বিশ্বের তিনজন নারীর প্রতি একজন এখনও নির্যাতন, শ্লীলতাহানী এবং বঞ্চনার শিকার হয়ে থাকে৷ আর বিশ্বের কোন কোন দেশে এই সংখ্যা প্রায় ৭০ শতাংশ৷
তাই স্বাভাবিকভাবেই, বিশ্বের অগনিত নারীর সমস্যা অনুধাবন করতে হবে আন্তর্জাতিক দিবসে নয়, জাতীয় আঙ্গিকে৷ কারণ, সমাজ ও প্রগতি অনুযায়ী বিশ্বের সব দেশে, সব ক্ষেত্রে নারীর অবস্থা সমান নয়৷
তিনি বলেন, নারীরা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক৷ সুতরাং, তাদের মালিকানা ও অংশ থেকে বঞ্চিত রেখে সমাজে প্রগতি আনা যায় না৷ কিন্তু, কোন একক পদ্ধতি আবিষ্কার করে এই প্রগতি কি সম্ভব ? ভৌগলিক ও পরিবেশগত অবস্থান, সংস্কৃতি, ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থান, ব্যক্তিত্ব, রুচি, ফ্যাশন সবকিছুই একজন মানুষের পোশাককে প্রভাবিত করে।
মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কর্মকর্তা বেপজার নাজমা বিনতে আলমগীর বলেন, প্রতি বছর অফিসের আনুষ্ঠানিকতা ও কর্মব্যস্ততার এবং অনান্য সামাজিক আয়োজন / অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নারী দিবস পালিত হয়েছে। এবছর সরকারি ছুটির কারনে নরী দিবস পালন করবো একান্ত নিজের কাছের মানুষদের নিয়ে এবং অবশ্যই পরিবার হবে প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। আসলে সম অধিকার অথবা মর্যাদায় সমান এই মানসিকতা বা স্বীকৃতি আসা দরকার প্রতিটি পরিবার থেকে। তাহলেই নারীরা সর্বত্র যোগ্য স্বীকৃতি পাবে ও সন্মানিত হবে। তিনি বলেন, একদিন নারী দিবস পালন করে অধিকার আদায়ের জন্য সোচ্চার হবার প্রয়োজন হবে না।
নরী দিবসে আমার প্রত্যাশা একদিন নারী দিবস পালন করা হয়তো একটু আনুষ্ঠানিকতা করা, কিন্তু আমরা নারীরা যদি নিজেদের পূর্ন অধিকার আদায় করে নিতে পারি, পরিবারে ও সমাজের সমগ্র বিচরন ক্ষেত্রের সার্বিক মর্যাদা পাই, তাহলে প্রতিটি দিনই আমাদের নারী দিবস আর বিশ্ব নারী দিবস পালিত হবে অধিকার আদায়ের জন্য নয় শুধুমাত্র আনন্দ উপভোগ করার জন্য। এটাই আমার প্রত্যাশা।
বেপজার মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কর্মকর্তা বলেন, এক কথায় আমার প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ও সহকর্মীদের মানসির শোভনীয়। তবে আমার প্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে নারী দিবস পালন করতে আমাদের অনেক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে, বেশ কয়েক বছর শুধুমাত্র নারীকর্মীবৃন্দ আমার রুমে এসে একত্রে খুবই সমান্য আয়োজেন নারী দিবস পালিত হয়েছে। উদ্যোগটি আমাকেই নিতে হতো কোন পুরুষ সহকর্মী নয়। পরবর্তীতে আমি আমার প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর কাছে দাপ্তরিকভাবে নারী দিবস পালনের প্রস্তাব করেছি।
তিনি প্রস্তাব অনুমোদন করাতে প্রতি বছর নারী দিবস অফিসিয়ালি পালিত হচ্ছে। তবে প্রতি বছরই আমাকো উদ্যোগ নিতে হয়, কোন পুরুষ সহকর্মী নিজের আগ্রহে উদ্যোগ নেয়না। এই দিবস পালনের মাধ্যমে আমার দপ্তরে একটি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র ও ব্রেষ্ট ফিডিং কর্নার করা হয়েছে। প্রতিটি ফ্লোরে নারীদের জন্য পৃথক ওয়াশরুম করা হয়েছে, দাপ্তরিক আনুষ্ঠানিক কেলেন্ডারের তালিকায় নারী দিবস স্থান করে নিয়েছে।
নারী দিবস পালনের মাধ্যমে নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি প্রভাবের গতী অত্যন্ত মন্হর, তবে বহু আলোচনা ফলে কিছুটা সুফল এসেছে। আমি মনে করি গ্রামে-গঞ্জে,শহরে সমাজের সর্বস্তরে মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। আর তাহলেই নারী মর্যাদায় সমান ও যোগ্য সন্মান ও স্বীকৃতি পাবে। জোর করে একদিন সমাজে বিশ্ব নারী দিবস পালনের চেয়ে সমাজের দৃষ্টিভংগী পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রতিটি দিন হোক নারীর জন্য সমাদৃত।
ধানমন্ডির গৃহিনী রাজনীতিবিধ সুষমি আফরোজ শীলা বলেন, প্রতিটি নারী তার পরিবারের সাপোর্টের অভাবে অনেক মেয়েই কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকতে পারে না। এছাড়া বাংলাদেশের মোড়ে মোড়ে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র তৈরি হওয়া দরকার। কর্মজীবী নারীর জন্য সন্তানের দেখাশোনা একটা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাই ঢাকা শহরসহ বড় শহরগুলোর প্রতিটি এলাকাতে একটি করে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র থাকলে এবং পারিবারিক সহযোগিতা থাকলে অনেক নারীর পক্ষেই পড়াশোনা ও কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। যতই নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হোক, এ সকল সহযোগিতা ছাড়া আসলে সেটা সম্ভব না।
পরিবারের সহযোগিতার অভাবে অনেক মেয়েই কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকতে পারে না। এছাড়া বাংলাদেশের মোড়ে মোড়ে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র তৈরি হওয়া দরকার। কর্মজীবী নারীর জন্য সন্তানের দেখাশোনা একটা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাই প্রতিটি থানায়, ঢাকা শহরসহ বড় শহরগুলোর প্রতিটি এলাকাতে একটি করে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র থাকলে এবং পারিবারিক সহযোগিতা থাকলে অনেক নারীর পক্ষেই পড়াশোনা ও কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। যতই নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হোক, এ সকল সহযোগিতা ছাড়া আসলে সেটা সম্ভব না।
শীলা বলেন, লিঙ্গবৈষম্য দূর করে নারীর অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু নিশ্চিত করাই নারী দিবসের মুল উদ্দেশ্য হোক। নারী দিবসে মা বোন, বন্ধুকে উপহার দিতে পারেন হ্যান্ডব্যাগ, ফটোফ্রেম, গল্পের বই, পারসোনালাইজড ক্যারিকেচার, গ্যাজেট বা ট্র্যাভেল সংক্রান্ত উপহার।
বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসনের চিকিৎসক ডা. শাহনাজ খান বলেন, নারীকে নারী হিসেবে তো নয়ই, মানুষ হিসেবেও নিজের পায়ে দাঁড়াতে দিতে চায়নি পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ৷ তবে তারপরেও, বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলির সঙ্গে তাল মিলিয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও নারীবাদি সংস্থা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন দলিল প্রকাশ করেছে৷
ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে হাত মিলিয়ে, ভারত-বাংলাদেশের মতো দেশও নারীর অধিকার বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়েছে৷ দক্ষিণ এশিয়ায় নারী অগ্রগতির জন্য প্রশংশিতও হয়েছে তারা৷ কেন না, মানুষ আজ হয়তো বুঝতে পেরেছে, যে কিছু পশ্চাদপদ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের হুমকিতে যে কোন দেশের সরকারই নারীর অগ্রযাত্রায় সহায়তার পথ থেকে সরে আসতে পারে না৷ তিনি বলেন, তাই স্বাভাবিকভাবেই দাবি উঠেছে নারীকে কোন ধর্মীয় পরিচয়ে নয়, বরং একজন মানুষ ও নাগরিক হিসাবে সমান সুযোগ, অধিকার ও মর্যাদা প্রদানের৷ পথ ধরেই, পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও নারীতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ব্যাখ্যা উঠে এসেছে৷
শ্যামলী টিবি ও অ্যাজমা হাসপাতালের সহকারি পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার বলেন, নারী মা নারী কারো কন্যা, নারী কারো স্ত্রী । যুগে যুগে নারীরা তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর সব জায়গায় রেখেছেন। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী ,স্পীকার, সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী। বাংলাদেশের নারীরা এখন উন্নত দেশ এর স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে।
তিনি বলেন, আজকের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক পরিবর্তন হয়েছে এখন নারীরা সব ক্ষেত্রেই নিজের অধিকার আদায় করে নিতে পেরেছে কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষিতভাবে কাজ করতে পারছে। নারীরা আগের চেয়ে অনেক স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছে। তাদের জন্য আইন তৈরি হয়েছে। নারী দিবসে আমার প্রত্যাশা বাংলাদেশে কর্মজীবী সব নারীর পাশে তাদের পরিবারগুলো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিক। যে মেয়েটা কর্মজীবী তার সন্তান ও সংসারের সহযোগিতা করার জন্য পরিবারকে পাশে পাক। তাহলে কর্মক্ষেত্রে আরো নারীরা এগিয়ে আসবে। প্রতিটা দিনই আসলেন নারীর দিন আলাদা করে দিবস উদযাপন করার অর্থ হলো সচেতনতা তৈরি করে ।
এসকেএইচ/এসএ
আপনার মতামত লিখুন :