তিন বছর আগে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের চিহ্ন এখনও শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন চিকিৎসক ইসরাত রফিক ঈশিতা। ভয়ংকর সেই পাঁচ দিনের কথা আজও ভুলতে পারেননি তিনি। পায়ে নির্যাতনের কালো দাগ দেখিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, ‘আমি বুঝতেই পারিনি আমার সঙ্গে র্যাব এমন আচরণ করবে। আমি বারবার কারণ জানতে চেয়েছি। তখন তারা আমাকে আরও মারধর ও গালিগালাজ করেছে।’
রবিবার (২২ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কাছে র্যাবের ৬ জন সদস্যের বিরুদ্ধে গুম ও নির্যাতনের অভিযোগ জমা দিয়েছেন ডা. ঈশিতা। এরপর গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
তিনি জানান, অভিযুক্তদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন—র্যাব সদর দফতরের স্কোয়াড্রন লিডার আলি আশরাফ, র্যাব-৪-এর তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আক্তারুজ্জামান ও আইডি বিশেষজ্ঞ রাকিব।
ডা. ঈশিতা বলেন, আমাকে ২০২১ সালের ২৮ জুলাই রাজধানীর কাফরুলের বাসা থেকে র্যাব সদস্যরা ধরে নিয়ে যায়। পাঁচ দিন গুম রাখার পর একই বছরের ১ আগস্ট র্যাবের মিডিয়া সেলে আমাকে উপস্থাপন করা হয়। পরদিন ২ আগস্ট আমার নামে তিনটি মামলা দিয়ে আদালতে পাঠানো হয়।
তিনি বলেন, ওই পাঁচ দিনে আমার ওপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। র্যাবের মিডিয়া সেলে সংবাদ সম্মেলন করে আমাকে ভুয়া চিকিৎসক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। আমার সার্টিফিকেট জাল বলে উল্লেখ করে কিছু মাদকসহ আমাকে আদালতে পাঠানো হয়।
তিনি অভিযোগে আরও উল্লেখ করেন, র্যাবের সদর দফতরে একটি কক্ষে নিয়ে আমার দুই পা ও বাহুতে লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। আমি কারণ জানতে চাইলে তারা আমাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে। আমাকে পাঁচ দিন র্যাবের হেডকোয়ার্টার্সে আটকে রাখার পরদিন (ষষ্ঠ) র্যাব-৪-এ পাঠানো হয়। পরে র্যাব-৪-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আক্তারুজ্জামান আমার চোখবেঁধে একটি জায়গায় নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে মাদকসহ ভিডিও ধারণ করা হয়। এরপর আবার আমাকে র্যাব সদর দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নেওয়ার পর তারা আমাকে তাদের ইউনিফর্ম পরিয়ে আমার ছবি তোলে। এরপর ২০২১ সালের ১ আগস্ট কাওরান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেলে নিয়ে তারা সংবাদ সম্মেলন করে। মিডিয়াকে তারা জানিয়েছিল, ওইদিন সকালে আমাকে মাদকসহ মিরপুর-১ থেকে গ্রেফতার করেছে। আমি মাদক ব্যবসায়ী। তারপর আমার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দিয়েছে র্যাব।
মামলা সম্পর্কে এই চিকিৎসক বলেন, যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া প্রচারণার অভিযোগে তিনটি মামলা দেয় র্যাব। এগুলোর মধ্যে একটি ছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলা। চলতি বছরের মে মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা থেকে ঈশিতাকে খালাস দেন উচ্চ আদালত। পাশাপাশি এই নারী চিকিৎসকের সঙ্গে র্যাবের এমন আচরণের কারণ জানতে তদন্ত করে তিন মাসের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন আদালত।
ঈশিতা জানান, ময়মনসিংহের কমিউনিটি বেইজড মেডিক্যাল কলেজ থেকে ২০১৪ সালে এমবিবিএস পাস করে টাঙ্গাইলের সখীপুরে একটি বাহিনীতে মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান তিনি। তবে সেখানে তিনি চাকরি চালিয়ে যেতে পারেননি। চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়ে চলে আসেন। চাকরি থেকে অব্যাহতির কারণ হিসেবে ঈশিতা বলেন, ‘সেখানে পরিবেশটা আমার অনুকূলে ছিল না। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কারণে আমি চাকরি ছেড়ে দিই। তার বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগও করে আসি। পরে শুনেছি ওই কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি।’
ওই কর্মকর্তার কথা উঠে এসেছে আদালতের পর্যবেক্ষণেও। গত ২৯ মে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের একক বেঞ্চ ঈশিতাকে ওই মামলা থেকে খালাস দিয়ে রায় দেন। পাশাপাশি উচ্চ আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, কোনও অজানা-অচেনা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার চাপে বা প্ররোচনায় ডা. ঈশিতাকে ফাঁসানো হয়েছিল। তাই এ ঘটনার নেপথ্যে কারা—তাদের খুঁজে বের করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
তবে অভিযোগ ওঠা ওই ছয় র্যাব সদস্যের নাম জানায়নি ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিম।
আপনার মতামত লিখুন :