শিরোনাম
◈ প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আমিনুল ইসলামের পদত্যাগ ◈ সেনাবাহিনী বিষয়ে ভলকার টুর্কের মন্তব্য নিয়ে যা বলল আইএসপিআর ◈ জুলাই ফাউন্ডেশনে এলো ৩ প্রতারক, ধরা পড়ে গেলো জালিয়াতি! ভিডিও ◈ চাঁপাইনবাবগঞ্জে দু'টি ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে  চালক নিহত   ◈ শিগগিরই নির্বাচনের ব্যাপারে আরও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ আসবে : অধ্যাপক আলী রীয়াজ ◈ রোহিত শর্মা অবসরে যাচ্ছেন না, খেলবেন ২০২৭ বিশ্বকাপ ক্রিকেট ◈ দুর্বল দলের বিরুদ্ধে কষ্টে জিতলো রিয়াল মাদ্রিদ ◈ বাংলাদেশে নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় যুক্তরাজ্য: সারাহ কুক ◈ শিশুকে বিষ পান করিয়ে হত্যাকারী সেই সৎ মা গ্রেপ্তার ◈ মাধবপুরে এসএম স্পিনিং মিলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, দশ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি

প্রকাশিত : ১০ মার্চ, ২০২৫, ১১:৫৫ দুপুর
আপডেট : ১০ মার্চ, ২০২৫, ০৩:০০ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

স্টারলিংক বাংলাদেশে অর্থনীতি ও নারীর ক্ষমতায়নে নতুন দিগন্ত খুলে দেবে: বিশেষজ্ঞদের মত

বাংলাদেশে স্পেসএক্সের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা ‘স্টারলিংক’ চালু হলে প্রযুক্তি, অর্থনীতি, ই-লার্নিং, শিল্প খাত এবং নারীর ক্ষমতায়নে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে, দুর্যোগকালীন সময়ে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে স্টারলিংক ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ার ফলে ইন্টারনেট সেবার দামও কমতে পারে। এ ব্যাপারে বিস্তর প্রতিবেদন করেছে ভয়েস অব আমেরিকা।

স্টারলিংক বাংলাদেশে চালু করার জন্য নেওয়া উদ্যোগ

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এ বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি স্পেসএক্সের মালিক ইলন মাস্কের সঙ্গে এক ভিডিও আলোচনায় বাংলাদেশে স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা চালুর বিষয়ে কথা বলেন।

সেই সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এসডিজির প্রধান সমন্বয়কারী লামিয়া মোর্শেদ এবং স্পেসএক্সের পক্ষ থেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট লরেন ড্রেয়ার এবং গ্লোবাল এনগেজমেন্ট অ্যাডভাইজার রিচার্ড গ্রিফিথস উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বাংলাদেশে নন-জিওস্টেশনারি অরবিট (এনজিএসও) স্যাটেলাইট সেবা প্রদানকারীদের জন্য একটি গাইডলাইন তৈরি করেছে। সেটি এখন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে রয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্টারলিংকের মতো নন-জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট প্রযুক্তির মূল সুবিধা হলো উচ্চগতির, তারবিহীন ও নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ। যা দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ব্যবহার করা সম্ভব। বর্তমানে দেশের অনেক দ্বীপ, চর, পাহাড়ি এলাকা ও গভীর বনাঞ্চলে ফাইবার অপটিক ক্যাবল বা মাইক্রোওয়েভ প্রযুক্তির মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া কঠিন। এসব এলাকায় স্টারলিংক সহজেই ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দিতে পারবে, যা সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করবে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বর্তমানে প্রচলিত ইন্টারনেট ব্যবস্থার একটি কার্যকর বিকল্প হিসেবে স্টারলিংক চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি শিক্ষা, ব্যবসা, স্বাস্থ্যসেবা ও ফ্রিল্যান্সিংসহ অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক লেখক ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন নন-জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট অরবিট সেবার জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। সেখানে এসব সেবার দাম একেবারে প্রতিযোগিতামূলক দামে নামিয়ে আনা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমান সরকার বিনিয়োগ বান্ধব। সেখানে সরকার স্টারলিংকসহ টেক-জায়ান্ট কোম্পানিগুলোকে জায়গা দিতে প্রস্তুত। এই জন্য এর লাইসেন্সের যে বিধিবিধান আছে, সেইগুলোকে সহজ করা হয়েছে। লাইসেন্স ফী একেবারে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে।’

বাংলাদেশে সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘বাংলাদেশে স্টারলিংক নিয়ে আসার ব্যাপারে ইলন মাস্কের সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূস কথা বলেছেন। স্টারলিংকের অফিসিয়াল কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। আমরা চাচ্ছি তারা বাংলাদেশে এসে অপারেশন শুরু করুক। চুক্তির ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে আসলে আমাদের জন্য ভালো হয়।’

তিনি বলেন, ‘নানা কারণে বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যায় কিংবা করে দেওয়া হয়। যেটা আমরা সর্বশেষ দেখেছি শেখ হাসিনা পতনের কিছুদিন আগে জুলাই ১৭-১৮ তারিখে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছে। তখন পুরো বাংলাদেশ ৬-৭ দিন ইন্টারনেট সম্পর্কিত অন্ধকারে ছিল।’

এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. এমদাদ উল বারীর পক্ষে সংস্থার মিডিয়া কমিউনিকেশন এন্ড পাবলিকেশন উইং জানায়, ‘দেশে বর্তমানে যে ইন্টারনেটের ব্যবস্থা রয়েছে তার একটি বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে নন-জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট অরবিট (স্টারলিংক ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সেবাদাতা সংস্থাসমূহ) ইন্টারনেট সেবা চালুর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।’

স্টারলিংক ইন্টারনেট, এডুকেশন সেক্টরে যেসব পরিবর্তন আনবে

বিটিআরসি ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে স্টারলিংক আসলে প্রান্তিক ও তৃণমূল অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে উচ্চগতির ইন্টারনেটের সংযোগ প্রাপ্তির সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। যার ফলে ই-লার্নিং, ভার্চুয়াল ক্লাসরুম, তৃণমূল পর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণার পথ প্রশস্ত হবে। এ ছাড়া বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষার্থীদের ভিডিও টিউটোরিয়ালসহ আধুনিক শিক্ষার পথ সুগম হবে। যার মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সিংসহ অনলাইনভিত্তিক কাজে সুযোগ বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, স্টারলিংক প্রযুক্তিগতভাবে অনেক আগানো এবং এতে অনেক সুযোগ-সুবিধা আছে। যার ফলে শিক্ষা, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন ধরনের গবেষণায় শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ আন্তর্জাতিকভাবে যুক্ত হওয়ার সুযোগ আরও বাড়বে।

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই যে, ছেলেমেয়েরা ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিশ্ব জ্ঞানভাণ্ডারে প্রবেশ করুক। সারা বিশ্বের নিত্যনতুন আবিষ্কার সম্পর্কে প্রতিদিনই আপডেট থাকুক। সেটা উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক সহজ করে দেবে।’

২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর সব স্কুল ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের আওতায় আনা, ইউনেস্কোর এমন একটি নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানান, বাংলাদেশে বর্তমানে স্কুলগুলোর ২৪/২৫ শতাংশের নিচে ইন্টারনেট সুবিধার আওতায় রয়েছে। তিনি বলেন, ‘এইক্ষেত্রে আমাদের হাতে ৬ বছরের কম সময় আছে। ফাইবার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এটা করা অনেক চ্যালেঞ্জিং। এই চ্যালেঞ্জ বিবেচনা নিলে স্টারলিংক একটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ডিজিটাল ডিভাইসের অপ্রতুলতা ভার্চুয়াল ক্লাসরুম গ্রাম পর্যায়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে আছে। ইন্টারনেটের সংযোগের ক্ষেত্রে স্টারলিংক এগিয়ে আসলে তখন ডিভাইস ব্র্যান্ডগুলো এগিয়ে আসবে। তখন আমরা ই-লার্নিং এর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান অর্জন করতে পারবো।’

টেলিকম ও প্রযুক্তি বিশ্লেষক মোস্তফা মাহমুদ হুসাইন বলেন, ‘স্টারলিংকের মাধ্যমে প্রত্যন্ত এলাকায় উচ্চগতির ইন্টারনেট পৌঁছালে অনলাইন ক্লাস, ভার্চুয়াল লাইব্রেরি, ভিডিও টিউটোরিয়ালসহ আধুনিক শিক্ষার সুযোগ সবার হাতে পৌঁছাবে। শহর ও গ্রামের শিক্ষার্থীরা একই মানের ডিজিটাল কনটেন্ট পাবে। ফলে ডিজিটাল ডিভাইড কমে আসবে। দুর্যোগ বা মহামারির সময়েও শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া সহজ হবে।’

গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ ও স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে স্টারলিংক

বাংলাদেশের প্রযুক্তিবিদ ও বিটিআরসির তরফ থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের গ্রামীণ ও তৃণমূল অর্থনীতির বিকাশে ছোট ও মাঝারি ব্যবসা প্রসারে ডিজিটাল কানেক্টিভিটি ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সেই জায়গায় স্টারলিংকের উচ্চগতির ইন্টারনেট গ্রামীণ উদ্যোক্তারা ই-কমার্স, ডিজিটাল মার্কেটিং, অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম ইত্যাদিতে যুক্ত হতে পারবেন। সরাসরি শহর ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য বিক্রি করে তাদের ব্যবসার পরিসর বাড়তে পারবে। স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে স্টারলিংক।

বিটিআরসির মিডিয়া কমিউনিকেশন এন্ড পাবলিকেশন উইং থেকে জানানো হয়েছে এনজিএসও স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেশে প্রত্যন্ত এলাকায় দ্রুত গতির ইন্টারনেট চালু করা গেলে গ্রামীণ ব্যবসায়িক কমিউনিটি তাদের ব্যবসায়িক লেনদেন থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে বড়-বড় শহরের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের সঙ্গে সমন্বয় করে তাদের ব্যবসায়িক পরিধি বৃদ্ধিতে সক্ষম হবে। এতে করে গ্রামীণ ও তৃণমূলের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হবে।

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির কাঠামোতে ৭৪-৭৫ শতাংশ ক্ষুদ্রঋণের আধিপত্য। সেখানে গ্রামীণ অর্থনীতির যারা মূলে আছেন তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে ইন্টারনেট সুবিধা পাচ্ছে না। লোডশেডিং হলে বাংলাদেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট থাকে না।

মোবাইল কোম্পানিগুলোর ইন্টারনেট কিছুটা থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মোবাইল কোম্পানিগুলোর টাওয়ারের পাওয়ার ব্যাকআপ ২ ঘণ্টার বেশি থাকে না, কিছুক্ষেত্রে হয়ত ৬ ঘণ্টা থাকে বলে জানিয়ে তৈয়্যব বলেন যে প্রচলিত প্রযুক্তির ইন্টারনেট সেবাগুলির এ ধরণের সীমাবদ্ধতা না থাকায় স্টারলিংকের মতো স্যাটেলাইট ভিত্তিক প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনার সক্ষমতা রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আব্দুর রাজ্জাক জানান, তিনি ১৬ বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকা গিয়ে দেখেছেন, সেখানে প্রত্যেক বাসায় ১০০ এমবিপিএস (মেগাবাইট পার সেকেন্ড) ইন্টারনেট চালু ছিল। যে গতির ইন্টারনেট সংযোগ আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের ( শহরগুলোর ) বেশির ভাগ অফিসেই নাই। এখন সেখানে (স্টারলিংক প্রযুক্তির কারণে) যদি গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে ১০০ এমবিপিএস ইন্টারনেট থাকে, তাহলে ঘরে বসেই অনেক কিছু করা সম্ভব হবে।

গ্রামীণ নারীর ক্ষমতায়নে স্টারলিংক অগ্রণী ভূমিকা রাখার প্রত্যাশা বিশেষজ্ঞদের

স্টারলিংকের আধুনিক প্রযুক্তির কারণে অনলাইন প্রশিক্ষণ ও স্কিল ডেভেলপমেন্টের সুযোগ পেলে নারীরা ঘরে বসেই ফ্রিল্যান্সিং বা ই-কমার্সে যুক্ত হতে পারবেন বলে মনে করেন প্রযুক্তি বিশ্লেষক মোস্তফা মাহমুদ হুসাইন।

এই প্রযুক্তিবিদ বলেন, ‘ডিজিটাল সংযোগের মাধ্যমে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সচেতনতায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়বে। আর্থিক স্বাবলম্বিতা ও সামাজিক অবস্থান উভয়ই মজবুত হবে।’

বিটিআরসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, উচ্চগতির ইন্টারনেটের মাধ্যমে নারীদের মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য সেবা, শিশু স্বাস্থ্য, অনলাইন শিক্ষা, টেলি-মেডিসিন, গার্হস্থ্য ও কৃষি বিষয়ক তথ্য, ই-কমার্স ও প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টিসহ নানা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটানো সম্ভব হবে। এই প্রতিষ্ঠানটি থেকে আশাবাদ ব্যক্ত করে জানানো হয়, স্টারলিংক এর মতো স্যাটেলাইট প্রযুক্তি নির্ভর ইন্টারনেট সেবা চালু হলে, গ্রামীণ নারীরা বিভিন্ন দক্ষতা অর্জন করে উদ্যোক্তা হওয়ার পাশাপাশি সামাজিক নেটওয়ার্ক সৃষ্টির মাধ্যমে সোশ্যাল বিজনেস গড়ে তুলতেও সক্ষম হবেন।

অধিক কনটেন্ট প্রাপ্তির সুযোগ বৃদ্ধির ফলে প্রত্যন্ত এলাকার নারীরা বিশেষ করে তরুণীরা সাইবার স্পেসে সুরক্ষিত থাকবেন মনে করেন বিটিআরসির কর্মকর্তারা।

নারী ক্ষমতায় স্টারলিংকের ইতিবাচক ভূমিকার জন্য নারীদের আলাদা প্যাকেজের ব্যবস্থা করতে হবে মনে করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তিনি বলেন, ‘নারী উদ্যোক্তা জন্য বিজনেস প্যাকেজ ও প্রমোশন লাগবে, সেটা করতে পারলে নারী উদ্যোক্তারা এখানে এগিয়ে আসতে পারবেন।’

‘এছাড়া আমরা যদি গ্রামে নিরবচ্ছিন্নভাবে ইন্টারনেট সরবরাহ করতে পারি, তাহলে যেসব নারীরা অনলাইনে বেচা-কেনা করে সেসব নারী উদ্যোক্তারা এগিয়ে যাবে,’ বলে উল্লেখ করেন তিনি।

নারীরা শিক্ষাসহ অন্যান্য দিক থেকে আগের চাইতে অনেক এগিয়ে গেলেও তারা এখনও দিনে-রাতে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে না বলে মনে করেন ঢাবির সিএসই বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আব্দুর রাজ্জাক।

তিনি বলেন, ‘সেই জায়গায় স্টারলিংকের উচ্চ গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সেবা পেলে তারা ঘরে বসে বিদেশের অনেক সেক্টরে প্রবেশ করতে পারে। তখন আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে ডাটা এন্ট্রি কিংবা পর্যালোচনা করে, ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্টসহ নানান কাজ করে অর্থ উপার্জনের সুযোগ তৈরি হবে নারীদের।’

দুর্গম অঞ্চলে ডিজিটাল বিপ্লবে ‘গেম চেঞ্জার’ হতে পারে স্টারলিংক

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামসহ অনেক দুর্গম অঞ্চলে ফাইবার অপটিক ক্যাবলের মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া কঠিন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা ও প্রযুক্তিবিদরা। তারা বলছেন, এসব এলাকার মানুষের জন্য স্টারলিংকের স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা একটি কার্যকর বিকল্প। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে পাওয়া উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ এসব অঞ্চলের স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য অনলাইন ব্যবসা সংক্রান্ত তথ্য প্রাপ্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে তাদের এগিয়ে রাখতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে এই প্রযুক্তি। একইসঙ্গে ভুল তথ্য ও গুজব প্রতিরোধ আরো দ্রুততার সাথে করা সম্ভব হবে। যা বাংলাদেশকে আরও এক ধাপ স্মার্ট কানেক্টিভিটির দিকে এগিয়ে নেবে।

প্রযুক্তিবিদ মোস্তফা মাহমুদ হুসাইন বলেন, ‘পাহাড়ি অঞ্চল বা দ্বীপাঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী অনলাইন মার্কেটপ্লেসে হস্তশিল্প কিংবা কৃষি পণ্য তুলতে পারবেন। পর্যটন, স্থানীয় সেবা ও স্বাস্থ্যসেবায় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি বাড়বে।’

আর বিটিআরসির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবার মাধ্যমে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের অনলাইন ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি, ব্যবসা সংক্রান্ত তথ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। এছাড়া, মিস ইনফরমেশন ও ডিস ইনফরমেশনের বিভ্রান্তি এড়ানো সহজ হবে বলেও প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।

উপকূলীয় অঞ্চলে নৌকাগুলো এখন মনিটরিংয়ের আওতায় নেই বলে উল্লেখ করে আইসিটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ‘স্টারলিংকের মাধ্যমে সেইগুলোতে ডিভাইস রেখে সহজে মনিটরিং কিংবা যোগাযোগ করা সম্ভব হবে। তবে,এক্ষেত্রে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়কে কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। এটা করা সম্ভব হলে উপকূলীয় অঞ্চলের মৎস্য, কৃষি ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন ঘটবে।

তিনি আরও বলেন, স্যাটেলাইট ইন্টারনেট দিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ভালোভাবে ব্যবস্থাপনা করা যাবে।

টেলিমেডিসিন এবং উন্নত চিকিৎসা সেবাকে সহজসাধ্য করবে স্টারলিংক

সরকারি সংস্থা বিটিআরসি বলছে, দেশের যে সকল স্থানে এখন পর্যন্ত ইন্টারনেট সংযোগ পৌঁছানো সম্ভব হয়নি সেসকল প্রত্যন্ত এলাকার জনগোষ্ঠীর জন্য টেলিমেডিসিন সেবা এবং উন্নত চিকিৎসা সেবাকে সহজসাধ্য করার জন্য উচ্চগতির ইন্টারনেট একান্ত আবশ্যক। এক্ষেত্রে, নন- জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট অরবিট একটি উপযুক্ত বিকল্প হতে পারে। রোগীরা চিকিৎসকের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করতে পারবে এবং স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রশিক্ষণ ও তথ্য বিনিময় করে তাদের দক্ষতা বাড়াতে সক্ষম হবে।

প্রযুক্তি বিশ্লেষক মোস্তফা মাহমুদ হুসাইন বলেন, ‘স্টারলিংকের মাধ্যমে সহজে শহরের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও গ্রামীণ রোগীর মধ্যে যোগাযোগ ঘটানো সম্ভব। দুর্যোগ বা বৈরী পরিবেশে স্যাটেলাইট সংযোগ সচল থাকে বলে জরুরি মেডিকেল সাপোর্ট ও ওষুধ সরবরাহে গতি আনবে।’

দুর্যোগকালে যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায় ভূমিকা রাখতে পারে স্টারলিংক

ঘূর্ণিঝড়, বন্যা বা অন্য দুর্যোগে স্থলভিত্তিক নেটওয়ার্ক প্রায় অকেজো হয়ে যায়। এক্ষেত্রে স্টারলিংকের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। উদ্ধারকাজ, তথ্য শেয়ারিং ও জরুরি সেবায় দ্রুত সমন্বয় করা সহজ হবে। দুর্যোগপূর্ব সতর্কতা ও মনিটরিং থেকে শুরু করে দুর্গতদের পুনর্বাসন পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া আরও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।

এই প্রসঙ্গে সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির মিডিয়া কমিউনিকেশন এন্ড পাবলিকেশন উইং থেকে বলা হয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নিয়মিত টেলিযোগাযোগ সেবার বিকল্প হতে পারে নন-জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট অরবিট সেবা। তাই স্থানীয় প্রশাসন ও উদ্ধারকারী দলগুলো দ্রুত তথ্য আদান-প্রদান করতে এবং জরুরি সেবা ও ত্রাণ কার্যক্রম ভালোভাবে সম্পন্ন করার জন্য টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা হিসেবে স্যাটেলাইটকেন্দ্রিক স্টারলিংকের মতো ইন্টারনেট সেবা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

স্টারলিংক ইকুইপমেন্ট মাঠপর্যায়ে সহজলভ্যে সরকারি ভর্তুকি, কর হ্রাসের প্রস্তাবনা

দেশের সকল মানুষকে সুলভে ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় আনতে ইতোমধ্যে বিটিআরসি থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

বিটিআরসির মিডিয়া কমিউনিকেশন এন্ড পাবলিকেশন উইং থেকে জানানো হয়- ইন্টারনেট ট্যারিফ কমানোর জন্য কমিশন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বাস্তবিকপক্ষে বর্তমানে স্টারলিংকের মতো নন-জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট অরবিট এর মাধ্যমে ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি ডিভাইস ব্যয়বহুল। এক্ষেত্রে কিস্তির মাধ্যমে ডিভাইস বাজারজাতকরণ এবং সহজ অর্থনৈতিক প্যাকেজ চালুর মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের কম দামে এ সংক্রান্ত সেবা প্রদান করা যেতে পারে।

অন্যদিকে প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি ভর্তুকি, কর হ্রাস, আমদানি শুল্ক রেয়াত ইত্যাদির মাধ্যমে সরঞ্জাম ও সেবার খরচ কমানো যেতে পারে। কমিউনিটি শেয়ারিং মডেল বা গ্রুপ-বাইংয়ের মাধ্যমে একাধিক ব্যবহারকারী মিলে খরচ ভাগাভাগি করলে অর্থনৈতিক চাপ কমবে। কিস্তিতে পেমেন্ট, এনজিওর ক্ষুদ্রঋণ ও স্থানীয় কর্পোরেট-সরকারি পার্টনারশিপের মাধ্যমে খরচ আরও সহনীয় করা সম্ভব।

একটি গোষ্ঠী ইন্টারনেট ব্যবসাকে মনোপলি করে রেখেছে বলে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘তারা একচেটিয়াভাবে ব্যবসা করে যাচ্ছে, সেটা ভেঙে ফেলা খুবই দরকার।’

উচ্চমূল্যের কারণে স্টারলিংক সংযোগ সব পর্যায়ের গ্রাহকের পক্ষে সরাসরি নেওয়া সম্ভব হবে না বলে মনে করেন আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, সেক্ষেত্রে কোনও কোম্পানি সংযোগ নিয়ে সাধারণ মানুষকে সেবা দিলে তাহলে সবার পক্ষে ব্যবহার করার সুযোগ তৈরি হবে। যাদের বিনিয়োগ করার সামর্থ্য আছে তারা করবে। তবে, ‘বাংলাদেশ জনঘনত্ব বিশিষ্ট দেশ হওয়া সুবিধা হচ্ছে অল্প জায়গায় অনেক গ্রাহক পাওয়া যাবে। এটা মোবাইল কোম্পানিগুলো এবং ব্রডব্যান্ড কোম্পানিগুলো পেয়েছে। সবাই সেই সুযোগ পেয়েছে।’

কর কমানো ও আমদানি শুল্ক রেয়াতের বিষয়ে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ‘সরকার কর হ্রাস, আমদানি শুল্ক রেয়াত বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।’

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়