প্রযুক্তির এই সময়ে এসে ড্রোনের ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এর পাশাপাশি এও সত্যি যে, এটির অপপ্রয়োগেরও শঙ্কা রয়েছে। যার মাধ্যমে জননিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব বিঘ্নিত হতে পারে; চলতে পারে নানা নাশকতামূলক ও অনৈতিক কাণ্ড। এ বিষয়ে একটি বিধিমালা প্রণয়ন ছিল তাই সময়ের দাবি। এরই ধারাবাহিকতায় নানা ধাপ পেরিয়ে অবশেষে ড্রোন বিধিমালা ২০২৪-এর খসড়া প্রণয়ন করেছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। বিধিমালায় অনুমতি ছাড়া ড্রোন ব্যবহারে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।
তিন ক্যাটাগরিতে ড্রোন নির্ধারণ করেছে সরকার। সর্বাধিক ২৫০ গ্রাম ওজনের খেলনা ড্রোন ছাড়া সব ধরনের ড্রোন ব্যবহারে উড্ডয়ন এলাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। রেড ও ইয়েলো জোনে ড্রোন ব্যবহারকারীর সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। প্রতিরক্ষা ও জননিরাপত্তা বিভাগের অনুমতি ছাড়া ড্রোন আমদানি করা যাবে না।
এ ছাড়া এর অপারেটর বা চালকের যোগ্যতা নির্ধারণ করে এ জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) থেকে সনদ নেওয়ার শর্তজুড়ে দেওয়া হয়েছে। উড্ডয়নের আগে বেবিচকের মাধ্যমে সরকারের ৭টি সংস্থার অনুমতিও লাগবে। এর আগে ২০২০ সালে ড্রোন নিবন্ধন ও উড্ডয়ন নীতিমালা জারি করে সরকার। সে সময় নানা রকম শর্তের বেড়াজালে মনুষ্যবিহীন এই আকাশযানের উড্ডয়ন কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাই প্রক্রিয়াটি সহজ করার পক্ষে অভিমত দেন সংশ্লিষ্টরা।
বিধিমালার খসড়ার বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আব্দুন নাসের খান জানান, ড্রোন বিধিমালার খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। সবার মতামত নিয়ে চূড়ান্ত হবে। জানা গেছে, ড্রোন আমদানি, প্রস্তুত ও উড্ডয়ন সব কটিই অনুমতির শর্তে আবদ্ধ। ড্রোন উড়াতে হলে প্রতিবারই বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) অনুমতি লাগবে। কিন্তু ব্যবহারকারীদের পক্ষে এ অনুমতি সবসময় নেওয়া সহজ নয়। কারণ এ জন্য বেশকিছু কাগজপত্র লাগে এবং এটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এ জন্য ড্রোন আমদানি, তৈরি ও উড্ডয়নের অনুমোদনের পুরো প্রক্রিয়াকে একই ছাতার নিচে আনার বিষয়ে জোর দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
খসড়া বিধিমালায় বলা আছে- ওপেন বা খেলনা জাতীয় ড্রোন ১০০ মিটার পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণযন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতাসম্পন্ন হিসেবে বিবেচিত। এ ধরনের ড্রোনে কোনো অডিও বা ভিডিও রেকর্ডিং সুবিধা থাকতে পারবে না। অনুমতির সুবিধার্থে স্পেসিফিক (অন্য সকল ড্রোন) ও সার্টিফায়েড (মানুষ ও পণ্য পরিবহন) ক্যাটাগরির কথা বলা হয়েছে। ১৬ বছরের অধিক বয়সী ব্যক্তির ড্রোন উড্ডয়নের ক্ষেত্রে বেবিচক নির্ধারিত প্রশিক্ষণ/ যোগ্যতা/ লাইসেন্স থাকতে হবে এবং আকাশসীমা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। অনুমোদন ছাড়া ড্রোন ব্যবহারে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। বেবিচক, পুলিশ ও অন্য যে কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার
অনুমতি ছাড়া ড্রোন ব্যবহার করলে দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এবং বেবিচক আইন, ২০১৭ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। বিধিমালা ভঙ্গ করে ড্রোন উড্ডয়নের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা/গোপনীয়তা, জননিরাপত্তা, বিমান চলাচলের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে প্রচলিত আইন ও বিধানাবলি সাপেক্ষে শাস্তিযোগ্য বিবেচিত হবেন।
উড্ডয়নের তিন জোন
ড্রোন অপারেশন জোনকে তিন ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করা হয়। গ্রিন, ইয়েলো ও রেড জোন। গ্রিন জোন মানে খেলনা ড্রোন ৬০ মিটার বা ২০০ ফুট পর্যন্ত উড্ডয়ন করবে।
আর ইয়েলো জোন হচ্ছে, বিমানবন্দরের ৩ থেকে ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা, কেপিআই ও তৎসংলগ্ন চতুর্দিকে ৫০০ মিটার, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, জনসমাগম, সভা-সমাবেশ ও উৎসবস্থল, ইত্যাদি ক্ষেত্রে বেবিচকের অনুমতি লাগবে। রেড জোন হচ্ছে বিমানবন্দরের তিন কিলোমিটার, নিষিদ্ধ এলাকা, সংরক্ষিত এলাকা, সামরিক এলাকা, বিপজ্জনক এলাকা, বিশেষ কেপিআই ও তৎসংলগ্ন চতুর্দিকে ১ কিলোমিটার, আন্তর্জাতিক সীমানা থেকে দেশের অভ্যন্তরে ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত। রেড জোনে ড্রোন উড্ডয়নের ক্ষেত্রে এলাকাভেদে পুলিশ, ডিজিএফআই, এনএসআই, বিজিবি নতুবা সংশ্লিষ্ট বাহিনীর অনাপত্তি সাপেক্ষে বেবিচকের বিশেষ অনুমতি প্রদান করা হতে পারে।
আমদানি নীতি
প্রতিরক্ষা ও জননিরাপত্তা বিভাগের অনাপত্তি সাপেক্ষে ড্রোন ও এর যন্ত্রাংশ আমদানি করা যাবে। প্রতিরক্ষা ও জননিরাপত্তা বিভাগের অনাপত্তি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করে ড্রোন ও যন্ত্রাংশ তৈরি ও সংযোজন কারখানা স্থাপন করারও সুযোগ আছে। প্রতিরক্ষা ও জননিরাপত্তা বিভাগের অনাপত্তিপত্র ইস্যুর এক বছরের মধ্যে অনুমোদিত স্পেসিফিকেশন মোতাবেক ড্রোন/যন্ত্রাংশ সরকারের আমদানি/রপ্তানি নীতিমালা অনুসরণ করে আমদানি করা যাবে।
নিবন্ধন বাধ্যতামূলক
ড্রোন উড্ডয়নে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। বেবিচক থেকে ড্রোনের নিবন্ধন ও পরিচিতি নম্বর নিতে হবে। ব্যবহারের উদ্দেশ্য, স্পেসিফিকেশনের কপি, ক্রয় বা আমদানির কাগজপত্র, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তি এবং বেবিচকের চাহিদা মোতাবেক অন্যান্য নথিপত্র জমা দিতে হবে। বিশেষ অনুমতি ছাড়া ভিভিআইপির সভা/সমাবেশ স্থানের দুই কিলোমিটারের মধ্যে অনুষ্ঠানের তিন দিন আগে থেকে ড্রোন উড্ডয়ন নিষিদ্ধ। উড্ডয়নের আগে বেবিচক কর্তৃক আকাশ প্রতিরক্ষা পরিচালন কেন্দ্র, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা, বিমান গোয়েন্দা পরিদপ্তর, পুলিশ অধিদপ্তর, বর্ডার গার্ড সদর দপ্তর এবং অন্য কোনো নিরাপত্তা বিভাগ/সংস্থা/বাহিনী থেকে আলাদাভাবে অনুমতি লাগবে।
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
ড্রোন উড্ডয়নকারী ও আগ্রহীদের মতে, বিধিমালা অনুযায়ী আমদানি করাই অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। আর স্থানীয়ভাবে কারখানা গড়া তো অনেক পরের বিষয়। এ ছাড়া প্রতিবার উড্ডয়নে অনুমতির পরিবর্তে এককালীন তিন মাস বা ছয় মাসের জন্য অনুমতি প্রদান এবং পর্যটনপ্রধান অঞ্চলকে সবুজ জোন হিসেবে ঘোষণা করে অনুমতি ছাড়া ড্রোন চালাতে দেওয়া উচিত।
দেশে জরুরি সাহায্য পাঠানো, গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে এখন ড্রোনের ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। আবার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রেও এর আবশ্যকীয়তা দিন দিন বাড়ছে। এ ছাড়া কৃষিকাজ ও কৃষির উন্নয়ন, আবহাওয়ার তথ্য সংগ্রহ, পরিবেশ ও ফসলের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, মশার ওষুধ বা কীটনাশক স্প্রে ছিটানোর জন্য ড্রোন ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ছাড়া বিনোদনচিত্র-প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ এবং গণমাধ্যমেও ড্রোনের ব্যবহার অস্বীকার করা যাবে না। দেশে বর্তমানে ৩০ হাজার ড্রোন ব্যবহারকারী রয়েছে। তারা মনে করছেন, অনুমতির প্রক্রিয়াটি এখনো খুবই কঠিন। তবে তারা এও বলছেন যে, কেউ কেউ অনুমতি না নিয়ে ড্রোন ব্যবহার করছে। এতে ঝুঁকি বাড়ছে। ড্রোন আমদানি করতে হলে অবশ্যই নির্দিষ্ট নিয়মকানুন মেনে তা আনতে হবে। যারা ব্যক্তিগত ভিডিও ধারণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়েই ড্রোন উড়াচ্ছেন তারাও অবৈধ কাজ করছেন। এরপরও প্রযুক্তির এই আধুনিক যুগে যেন এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা যায়, সেটি বিবেচনা করতে হবে সর্বাগ্রে। সূত্র : দৈনিক আমাদেরসময় পত্রিকা
আপনার মতামত লিখুন :