মিনহাজুল আবেদীন: পদবি ছাড়া সারা জীবন বাঁচতে পারবো না। মা, আমার বাবা কে- ছেলের এই প্রশ্নে নাজেহাল হয়ে গিয়েছিলেন মহিলা। এই প্রশ্ন করায় ছেলেকে বার কয়েক বকুনিও দেন। কিন্তু লাভ হয়নি। ‘বাবার নাম না বললে আত্মহত্যা করবো’, ছেলের এই ‘হুমকি’ শুনে আর সত্যিটা চেপে রাখতে পারেননি মহিলা। নাবালিকা থাকাকালীন তার জীবনে যে বিভীষিকার সাক্ষী হয়েছেন, তা ছেলেকে বললেন।
তার ১২ বছর বয়সে উত্তরপ্রদেশে ওই মহিলাকে ধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ। ছ’মাসেরও বেশি সময় ধরে তাকে ধর্ষণ করেন দুই ব্যক্তি, এমনই তার জেরেই তিনি অন্তঃসত্ত্বা হন। আনন্দবাজার
মায়ের অতীতের কথা শোনার পর মুষড়ে পড়েননি ছেলে। বরং মা যাতে ন্যায্য বিচার পান, তা সুনিশ্চিত করতে মায়ের হাত শক্ত করেছেন তিনি। মা-ছেলের এই কাহিনিই এখানে তুলে ধরা হলো।
জানা গেছে, প্রায় ২৮ বছর আগে ১৯৯৪ সালে উত্তরপ্রদেশের শাহজাহানপুরে ১২ বছর বয়সি এক নাবালিকাকে ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে ধর্ষণ করার অভিযোগ ওঠে দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে। কিন্তু এই ঘটনা জানাজানি হয়নি। পুলিশে কোনো অভিযোগও দায়ের হয়নি। ধর্ষণের জেরে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে ১২ বছরের নাবালিকা। কিন্তু গর্ভপাত করাতে পারেনি পরিবার। এতো অল্প বয়স ও তার শারীরিক অবস্থা বুঝে গর্ভপাত করানোর সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেন চিকিৎসকরা।
তাই আর চার-পাঁচ জন নাবালিকার মতো যখন স্কুলে পড়াশোনা, খেলে বেড়ানোর কথা, তখনই মা হয় ওই নাবালিকা। তবে সন্তানের মুখ দেখেনি সে। ওই সন্তান দত্তক নেন এক দম্পতি।
মহিলার কথায়, ‘বাচ্চার জন্য কতো কষ্টই না পেয়েছি। কিন্তু ওর মুখ দেখার সুযোগ পাইনি। মা’কে যখন বলতাম, মা বলতো, জীবনে দ্বিতীয় সুযোগ পাবে।’
ধর্ষণের ঘটনা জানাজানি হলে মহিলার পরিবারকে শেষ করে দেয়া হবে। বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হবে। অভিযুক্তদের এই হুমকিতে ভয়ে পুলিশে অভিযোগ জানাতে পারেনি মহিলার পরিবার। মনে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে যখন স্কুলে যেত ১২ বছরের নাবালিকা, স্বপ্ন দেখতো, সে বড় হয়ে পুলিশ হবে। কিন্তু পড়শি দুই ব্যক্তির এই বর্বরোচিত আচরণে তার সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
এই ঘটনার পর আর পড়াশোনা চালাতে পারেননি ওই মহিলা। নারকীয় ঘটনার স্মৃতি ঢাকতে মহিলার পরিবার রামপুর জেলায় চলে যায়। এরপর ২০০০ সালে মহিলার বিয়ে হয়। তার দ্বিতীয় সন্তান হয়। ভেবেছিলেন, অতীত ভুলে নতুন করে তার জীবন শুরু হয়েছে। কিন্তু ভাগ্যে সুখ বেশি দিন টিকলো না।
বিয়ের ছ’বছরের মধ্যেই মহিলার অতীতের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা জেনে যান তার স্বামী। তার পরই পুত্রসহ ওই মহিলাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে বার করে দেন তার স্বামী।
জীবনে দ্বিতীয় ধাক্কা খেয়ে ছেলেকে নিয়ে ওই মহিলা বোনের বাড়িতে ওঠেন। অতীতের ভয়ঙ্কর স্মৃতির পীড়ায় যখন মহিলা বিদ্ধ, তার প্রথম সন্তানেরও জীবনেও আলো ফোটেনি। পরিচয় নিয়ে সমাজের নানা স্তরে বারবার লাঞ্ছিত হতে হয় তাকে।
বড় হয়ে যখন ওই যুবক জানতে পারেন যে, যাকে বাবা-মা বলে ডাকেন, আসলে তারা তার নিজের বাবা-মা নন, তখন স্বাভাবিক ভাবেই ভেঙে পড়েন।
১৩ বছর বাদে মা-ছেলের পুনর্মিলন ঘটে। যারা দত্তক নিয়েছিলেন ওই ছেলেকে, তারা আসল মায়ের কাছে ফেরত দেন।
আরো একটু বড় হলে পিতৃপরিচয় জানার জন্য মরিয়া ওঠেন ওই যুবক। শেষে যখন মায়ের অতীত জানতে পারেন ওই যুবক, তখন ভেঙে পড়েননি। বরং মাকে সাহস জুগিয়েছেন।
মায়ের সঙ্গে যে অন্যায় হয়েছে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। অভিযুক্তদের সাজা দিতে হবে। সুবিচারের জন্য মাকে নিয়ে লড়াই শুরু করেন তিনি।
ছেলের উৎসাহে যেনো এতো ধাক্কা-আঘাত সয়েও অক্সিজেন পান ওই মহিলা। ছেলের জন্যই ২০২০ সালে শাহজাহানপুরে যান ওই মহিলা।
কিন্তু এতো পুরনো ঘটনায় মামলা দায়ের করতে অস্বীকার করে পুলিশ। আইনজীবীও মুখ ফেরান। অভিযুক্তদের হদিস পাওয়া যায়নি। এমনকি, শাহজাহানপুরে যে বাড়িতে বড় হয়ে ওঠা মহিলার, তারও কোনো চিহ্ন পাননি তিনি।
এমতাবস্থায় কীভাবে তদন্ত সম্ভব? তথ্যপ্রমাণই বা পাওয়া যাবে কী ভাবে? তিন দশকের পুরনো এই মামলায় তাই পুলিশ, আইনজীবীরা মুখ ফেরান। কিন্তু হাল ছাড়েননি মহিলা। আইনজীবীকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করান। ২০২১ সালের মার্চে শাহজাহানপুর আদালতে মামলা দায়ের করেন তার আইনজীবী।
নিজেই অভিযুক্তদের খুঁজে বার করেন ওই মহিলা। তাদের ফোন করে ওই মহিলা বলেন, ‘এখন তোমাদের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করার সময় এসে গিয়েছে।’ ছেলের ডিএনএ পরীক্ষা করানো হয়। অভিযুক্তদেরও ডিএনএ পরীক্ষা করানো হয়। দু’জনের মধ্যে এক জনের ডিএনএ পরীক্ষার ফল মিলে যায়।
গত ৩১ জুলাই এক অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশি হেফাজতে রয়েছেন অপর অভিযুক্ত। তিন দশকের পুরনো মামলাতেও যেভাবে অভিযুক্তদের ধরা হলো, তা একপ্রকার দৃষ্টান্ত বলেই মনে করছে পুলিশ মহল।
বিবিসিকে মহিলা জানান, ‘লোকেরা চুপ করে বসে থাকে। আমিও তাই করেছিলাম। কিন্তু আমাদের পুলিশের কাছে যাওয়া উচিত।’ অভিযুক্তরা গ্রেপ্তার হওয়ায় খুশি তার ছেলেও।
আপনার মতামত লিখুন :