মিনহাজুল আবেদীন: মধুবনি জেলার সৌরথ গ্রামের একটি মাঠের কোনায় দাঁড়িয়ে আছেন নির্ভয় চন্দ্র ঝা। ৩৫ বছর বয়সী এই ব্যক্তির চেহারায় কিছুটা সংশয়। আজ একটি বিশেষ দিন তার জন্য।
বেগুসারাই থেকে ১০০ কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে তিনি সৌরথ গ্রামের এই মাঠে এসেছেন। কারণ এ মাঠে বসেছে ‘সভা’ বা বার্ষিক ‘বরবাজার’। নির্ভয়ের প্রত্যাশা, কোনো উপযুক্ত কনে পরিবারের নজরে পড়বেন তিনি। এই ‘বরবাজারে’র জন্য বিহারের গ্রামটি বিখ্যাত।
৭০০ বছরের পুরোনো এই ঐতিহ্যবাহী হাটে বিয়ে করতে আগ্রহী মৈথিল ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলেরা আসেন। তাদের প্রত্যেকেই নিজের জন্য পণের ট্যাগ লাগিয়ে রাখেন। হাটে আসা বিবাহযোগ্য মেয়ের পুরুষ অভিভাবকেরা, সাধারণত বাবা বা ভাই উপযুক্ত পাত্রকে বেছে নেন। সাধারণত এই প্রক্রিয়ায় কনের পছন্দ বা অপছন্দ কিছুই বলার থাকে না।
বিহারের মিথিলাঞ্চলে বসবাসকারী হিন্দু ব্রাহ্মণদের একটি উপগোষ্ঠী মৈথিল ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় হলো হিন্দুদের বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে প্রভাবশালী সামাজিক গোষ্ঠী। ঐতিহাসিকভাবে এ গোষ্ঠী সমাজের সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করে আসছে।
মৈথিল ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে নির্ভয় অপেক্ষায় আছেন, যেকোনো মুহূর্তে কোনো পাত্রীর পরিবার তার কাছে এসে পণ নিয়ে আলোচনায় বসতে পারেন। প্রকাশ্যে তিনি নিজের জন্য ৫০ হাজার রুপির (৬৩০ ডলার) ট্যাগ লাগিয়ে রেখেছেন।
নির্ভয় আল জাজিরাকে বলেন, ‘আমার বয়স আরো কম হলে সহজেই আমি দুই থেকে তিন লাখ রুপি যৌতুক চাইতে পারতাম।’
হিন্দুরা সমজাতির মধ্যে বিশেষ করে, একই বর্ণের মধ্যে বিয়েকে উত্সাহিত করে। কারণ, এ ধরনের বন্ধনগুলো বেশির ভাগ পরিবার থেকে আয়োজন করে করা হয়। নির্ভয় একটি কারখানায় ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করেন। মাস শেষে ভালোই বেতন পান। তাই তিনি মনে করেন স্বামী হিসেবে তিনি উপযুক্ত পছন্দ হতে পারেন।
পণ বা যৌতুক ভারতে বেআইনি হলেও এর প্রচলন এবং সামাজিক স্বীকৃতিও রয়েছে। বিশেষ করে বিহার এবং পার্শ্ববর্তী উত্তর প্রদেশ রাজ্যে। বিশেষজ্ঞরা হিসাব করে দেখেছেন, ভারতে এক বছরে ৫০০ কোটি রুপির যৌতুক দেয়া হয়, যা দেশটির বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের সমান।
মধুবনির পাশের একটি গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, এটা অনেকটা এমন যে কনের পরিবার উপযুক্ত যৌতুক দিয়ে পছন্দের বর কিনে নিতে পারবে। মৈথিল ব্রাহ্মণদের কাছে এটি খুবই পবিত্র রীতি।
তবে পাত্রীর অভিভাবকেরা গোপনে এই গ্রামে এসে পাত্র সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে যায়। এরপর তাদের যদি কাউকে পছন্দ হয়, তাহলে তারা ওই পাত্রকে মিথিলা গামছা এবং একটি লাল শাল পরিয়ে দেন।
গণপরিবহনে আগে এলে আগে বসার সুযোগ পাওয়ার ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে মধুবনি গ্রামের বাসিন্দা জয়তী রমন ঝা বলেন, ‘এটা বাসের সিটে রুমাল রাখার মতোই’। কিন্তু এখন এই হাটে পাত্রদের উপস্থিতি কম হওয়ার বিষয়টি বলে দেয় ঐতিহ্যটি এখন ক্ষয়প্রাপ্ত। তারপরও উপযুক্ত পাত্রের খোঁজে এখনো এই হাট উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অনেককেই আকর্ষণ করে।
পঞ্জিকার পদ্ধতিটি হলো বর ও কনে তাদের বাবার দিকের সাত প্রজন্ম এবং মায়ের দিকে থেকে পাঁচ প্রজন্মের জন্য রক্তের সম্পর্ক থাকতে পারবে না। রেজিস্ট্রার এই বিষয়গুলো ভালো করে যাচাইবাছাই করে বর-কনের বিয়ে হতে পারে, এমন অনুমোদন দেন।
কেউ কেউ বলেন, পুরোনো দিনে বরদের জন্য যৌতুকের বিভিন্ন ট্যাগসহ খোলা নিলাম হতো। বরের পেশা যত বেশি মর্যাদাপূর্ণ, যৌতুকের দাবি তত বেশি। প্রকৌশলী, চিকিৎসক এবং সরকারি কর্মীদের কদর ছিলো সবচেয়ে বেশি।
কিন্তু বর্তমান সমাজব্যবস্থা অনেক পাল্টে গেছে। বর্তমানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানুষের শহরমুখী হয়ে পড়া অনেক ভারতীয়কে পারিবারিক ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করেছে। এখন আর আগের মতো সন্তানদের বিয়ে অভিভাবকদের সিদ্ধান্তেই হয়, এমনটা নয়। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এবং অনলাইনে পাত্র-পাত্রীদের পছন্দের সাইট বাড়ার কারণে অনেকে এখন অনলাইনে ঝুঁকছেন। ভারতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বড় কয়েকটি বিবাহসংক্রান্ত ওয়েবসাইট রয়েছে।
সৌরথ সমাবেশ অবশ্য পারিবারিক সিদ্ধান্তে আয়োজিত বিয়ের ব্যবস্থার অবশিষ্টাংশ, যেখানে এখনো প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগেনি। হাটটি বসে গ্রামের একটি পুকুরের পাশে। যেখানে কয়েক ডজন অশ্বথ, বট, আমগাছ এবং অনেক পুরোনো একটি মন্দির রয়েছে। রয়েছে বিশাল কিন্তু অব্যবহৃত কূপ।
৫০ বছর বয়সী স্বরাজ চৌধুরী আল জাজিরাকে বলেন, ‘আগের দিনগুলোতে, লোকজনকে এ সভায় আনার জন্য বাসগুলো রাজ্যজুড়ে চলতো। আর এখন কয়েক শ বর জড়ো হয়, যা খুব কমই।’
শেখর চন্দ্র বলেন, আজকাল যৌতুককে সুনজরে দেখা হয় না, কিন্তু টেবিলের নিচ দিয়ে ঠিকই তা চলে। যদি বাবা-মায়েরা তাদের ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বা চিকিৎসক বানানোর জন্য অর্থ বিনিয়োগ করে থাকেন, তাহলে তারা সেই বিনিয়োগ ফেরত চাইতে পারেন। আর এ ক্ষেত্রে যৌতুককে একটি অন্যতম উপায় হিসেবে দেখা হয়।
বিহারে যৌতুক একটি বড় সমস্যা। সরকার যৌতুকবিরোধী প্রচারাভিযান শুরু করলেও যৌতুকের কারণে মৃত্যু ও হত্যা এখানে সাধারণ ঘটনা। ২০২০ সালের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, বিহারে ওই বছর যৌতুকের কারণে এক হাজারের বেশি মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে, যা দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
বিশেষজ্ঞরা হিসাব করে দেখেছেন, ভারতে এক বছরে ৫০০ কোটি রুপির যৌতুক দেয়া হয়, যা দেশটির বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের সমান।
এই হাটে পাত্রের উপস্থিতি কমার বিষয়ে স্থানীয় লোকজন বলছেন, ব্রাহ্মণদের মধ্যে আন্তবর্ণ বিবাহ বাড়ছে, যাকে স্থানীয়ভাবে ‘উরহর শাদি’ বা প্রেমের বিয়ে বলা হয়। বিহারের দারভাঙ্গার মনীশ ঝা। বয়স ৩১ বছর। তিনি নিজের বর্ণের বাইরে গিয়ে একজন রাজপুত নারীকে বিয়ে করেন। এ জন্য তার পরিবার ও সম্প্রদায়ের অনেক বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছিলো তাকে।
মনীশ আল–জাজিরাকে বলেন, ‘একবার আমাকে বন্দুকের মুখেও পড়তে হয়েছে। কিন্তু আমি তাকে (বর্তমান স্ত্রী) অনেক ভালোবাসি, তাই মৃত্যুর হুমকি উপেক্ষা করেই ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করেছি।’ তাদের ঘরে এখন ছেলেসন্তান আছে।
মনীশ আরও বলেন, নতুন প্রজন্ম এখন আর কোনো বর্ণের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে চায় না। তারা জাতপাত ভুলে যাকে ভালোবাসে তাকে বিয়ে করতে চায়। প্রথম আলো
আপনার মতামত লিখুন :