পাত্র থেকে গুড়মাখা নারিকেল নিয়ে বানানো হচ্ছে গোলাকৃতি নাড়ু। পাশে ভাজা বাদামগুলো পলিথিনের প্যাকেটে ভরছেন আরেক জন নারী। একসময় টিন ভর্তি নাড়ু আর বাদাম নিয়ে পথে নামলেন ৭৬ বছরের অন্ধ বৃদ্ধ আব্দুল গফুর মল্লিক।
স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, উনি এমন একটা লোক। কারও কাছে হাত পাতে না। অসহায় হলেও নিজের ধারে নিজে ধাকে।
আব্দুল গফুর মল্লিকের বাড়ি রাজবাড়ী সদর উপজেলার পাচুরিয়া ইউনিয়নের খোলাবাড়িয়া গ্রামে। জন্মের পর থেকেই দুই চোখে দেখতে পান না তিনি। তাই, ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণ দুঃশ্চিন্তায় পড়ে যান তার বাবা।
আব্দুল গফুর মল্লিক বলেন, আমার যখন ১৬ বছর বয়স। তখন আমার বাপ আমারে বলছিলো এক সিপারা কোরআন শরীফ পইড়া। গাড়ির লগে হাত পাতবি পয়সার লাইগা। আমি বলছিলাম আমি ছোট ব্যবসা করবো না। পাঁচ সিকা দিয়া ৫ প্যাকেট বিড়ি এনে ব্যবসা শুরু করি।
এক সময় বিড়ি বিক্রি বাদ দিয়ে নিজের তৈরি নাড়ু আর বাদাম বিক্রি করতে শুরু করেন তিনি। দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে এভাবেই জীবন চলে আবদুল গফুরের।
এক মহিলা জানান, সকাল বেলা রান্না বান্না করি দেয়। বাদাম ভাজে, ঝুড়ি ভাজে, দিলখোশ বাসায় নাড়ু বানায় গিরামে যায়। নাড়ু বানায় তা নিয়ে গিরামে যায়। তা নিয়ে টুকটাক বেচাকেনা করে। রাতে আবার আসে।
আবদুল গফুরের কাছে পুরো পৃথিবীটাই অন্ধকার। বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে গিয়েছে শরীরটা। তবুও তিনি হেটে যান ক্লান্তিহীন। যতো কষ্টই হোক ব্যবসার উপার্জিত অর্থেই খেতে চান তিনি। কোনমতেই ভিক্ষাবৃত্তি নয়।
আব্দুল গফুর মল্লিক বলেন, ভিক্ষে করলে কিছু কিছু লোক ঘিন্না করতো। ১২ আনা লোক ঘিন্না কইত্বো। ৪ আনা লোক ভালো বলতো। জন্মান্ধ গফুরের ঘরে কোনও সন্তানও দেননি বিধাতা। তাইতো নিজ পুত্রের মতোই শিশুকাল থেকে পালন করছেন সহোদর ভাইয়ের ছেলে আব্দুল বাতেন মল্লিককে।
আব্দুল বাতেনের মা বলেন, আমার ছেলেকে ছোট থাকা অবস্থায় কইছে ভাবী আমারে দিয়ে দাও। আমি বললাম নে আমার ছেলেটা নে। এই যে ছাপড়া ঘরটা উঠায়ে দিছে আমার ছেলে। ওই ঘরঠায় থাকে দুইজন।
অন্ধ স্বামীকে নিয়ে হাসিমুখে দীর্ঘ জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন নুরজাহান বেগম। ভাঙ্গা ঘর, অভাবের সংসার। তবুও নিজেকে একজন সুখী নারী বলে মনে করেন তিনি। আবদুল গফুরের স্ত্রী নূরজাহান বেগম বলেন, এই ভালো, এই মন্দ। এই স্বামী নিয়েই পইড়া থাকি। যতদিন বাইচা থাহি এই স্বামী নিয়েই পইড়া থাহি আরকি।
আশপাশের মানুষের কাছে ভীষণ শ্রদ্ধার পাত্র আবদুল গফুর। শত অভাবেও তিনি যে ভিক্ষার জন্য হাত বাড়ান নি, এই বয়সেও উপার্জন করে খাচ্ছেন। এই বিষয়টিই তাদের অবাক করে। স্থানীয় এক বিক্রেতা বলেন, সে অত্যন্ত ভালো মানুষ। কাজ করে খায়, আমার দোকান থেকে সবসময় বাদাম টাদাম নেয়। সে কাজ করে খাবেন, তবুও কারও সাহায্য বা দান সে নেবে না।
স্থানীয় আরেক ব্যক্তি বলেন, এই বয়সেও তিনি পরিশ্রম করে অনেক পরিশ্রম করে। কোনদিনও আমি দেখিনাই যে কারও কাছে ২ টাকার জন্য হাত পাতছে। অন্যান্য ভিক্ষুকদের জন্য তিনি অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবে।
আবদুল গফুর আমাদের সমাজের জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত, বললেন জেলা প্রশাসক আবু কায়সার খান। তিনি বলেন, জনাব গফুর মিয়া আমাদের সমাজে একজন অনুকরণীয় ব্যত্তিত্ব। তারপরও উনি কুটির শিল্পের মাধ্যমে নারিকেলের নাড়ু উৎপাদন করে এবং বিক্রি করে। অন্যের দান গ্রহণ করেন না। অন্যান্যদের মতো ভিক্ষাবৃত্তি করেন না। সরকারের পক্ষ থেকে ওনাকে একটি প্রতিবন্ধী কার্ড দেওয়া হয়েছে। উনি নিয়মিত প্রতিবন্ধী ভাতা পেয়ে থাকেন। এরপরও জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে উনার জীবন মান উন্নয়নের জন্য আমরা সহযোগিতা করবো।
ভিক্ষাবৃত্তি যে একটি ঘৃণিত পেশা এবং কাজ করে খাওয়াটাই যে মর্যাদাপূর্ণ। সে কথাই সবাইকে যেন স্মরণ করিয়ে দিলেন রাজবাড়ীর এই বয়স্ক মানুষটি।
আপনার মতামত লিখুন :