ইউসুফ আলী, দিনাজপুর: [২] প্রতিবেশী বৃদ্ধের কাছে গল্প শুনে বাঁশ ফুলের বীজ থেকে দানা (চাল) সংগ্রহ করে এলাকায় তাক লাগিয়ে দিয়েছেন দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার এলুয়াড়ী ইউনিয়নের পাকাপান গ্রামের যুবক সাঞ্জু রায়। তিনি এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার টাকার এই দানা বা চাল বিক্রি করেছেন। তার সংগ্রহে রয়েছে আরও ৫ থেকে ৬ মন বাঁশ ফুলের বীজ।
[৩] অপরদিকে উৎসুক এলাকাবাসীর মধ্যে বাঁশ ফুলের বীজের দানা (চাল) সংগ্রহ করার হিড়িক পড়েছে। এই দানার ঘ্রান আতপ চালের মত হওয়ায় এই দানা দিয়ে অনেকে আট তৈরি করে পিঠা পুলি পায়েশ ও চালের পোলাও রান্না করছেন।
[৪] যুবক সাঞ্জু রায় (২৫) দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার এলুয়াড়ী ইউনিয়নের পাকাপান গ্রামের কৃষক ছিমল রায়ের ছেলে।
[৫] গত রোববার সরেজমিন এলাকায় গিয়ে জানা যায়, পাকাপান গ্রামের সাঞ্জু রায় ও প্রতিবেশী বৃদ্ধ কালিচন্দ্র রায় (৭০) দু‘জনেই দিনমজুর। তার কয়েকদিন আগে মাঠে কাজ করে ওই গ্রামের মানিক চন্দ্র রায়ের অনেক পুরোন একটি বাঁশ ঝাড়ের নীচে ছায়ায় বনে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এ সময় বৃদ্ধ কালিচন্দ্র রায় ওই বাঁশ ঝাড়ে বাঁশ ফুল ও দানা দেখে সাঞ্জু রায়কে গল্প শোনান যে ১৯৭১ সালে এরকম বাঁশ ঝাড়ের বাঁশ ফুলের দানা থেকে চাল সংগ্রহ করতে দেখেছেন। সে সময় অনেকেই এই দানা চাল হিসেবে ভাত রান্না করে খেয়েছেন। এই কথা শুনে সাঞ্জু রায় কিছু দানাদার বাঁশ ফুল সংগ্রহ করে হাতে ডলা দেন। ডলা দিতেই হুবহুব চালের মত দেখতে সাদা দানা বের হয়ে আসে। যার ঘ্রান আতপ চালের মত। তিনি ওই দানা গুলো খেয়ে দেখেন চালের মত স্বাদ। পরে তিনি এই দানা নিজের পরিবারের সদস্যদের খাওয়ান। ভাতের মত স্বাদ পেয়ে সাঞ্জু রায় রীতিমত ব্যাপক ভাবে বাঁশ ফুলের দানা সংগ্রহ করে চাল উৎপাদন শুরু করেন।
[৬] এ খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে অনেকে ৪০ টাকা কেজি দরে বাঁশ ফুলের দানা (চাল) সংগ্রহ করেন। বিষয়টি এলকায় ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়লে বাঁশ ফুলের চাল সংগ্রহের হিড়িক পড়ে যায়।
[৭] সাঞ্জু রায়ের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির পাশের ঝাড় থেকে বাঁশের বীজ সংগ্রহ করছেন তিনি। তার মা বাঁশ পফুল গুলো কুলা দিয়ে ঝেড়ে পরিস্কার করছেন। সেই বীজ পানিতে ধুয়ে সাঞ্জু রায় পরিষ্কার করে রোদে শুকাচ্ছেন। এরপর সেগুলো ধানের হাসকিং মিলে ভাঙাবেন। বাড়ির উঠানে প্রস্তুতকৃত এমন কয়েকটি বীজের বস্তা দেখা যায়। কিছু দানা ভাঙিয়ে রেখেছেন, গ্রামের অনেকেই তা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। বাঁশের ফুল থেকে চালের মতো উৎপাদন করার বিষয়টি এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এটি দেখতে প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে উৎসুক মানুষ ভিড় করছেন তার বাড়িতে।
[৮] সাঞ্জু রায়ের প্রতিবেশী সাবিত্রি রানী, লিপি রানী ও সিমলা রায় জানালেন, বাঁশের বীজ থেকে দানা সংগ্রহ করার বিষয়টি তারা প্রথমে সাঞ্জু রায়ের ছেলে মানুষি ভেবেছিলেন। পরে তার এই দানা সংগ্রহ দেখে তাজ্জব বনে যান! বর্তমানে তার এই উৎপাদিত দানা অনেকেই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
[৯] নীলা রানী নামে এক গৃহবধু বাঁশ ফুলের দানা থেকে পাওয়া চাল দিয়ে পায়েশ রান্না করেছেন। তিনি অনেককেই এই পায়েশ খাওয়ান।
[১০] ফিরোজা রানী রায় বলেন, এই বাঁশ ফুলের দানা থেকে পাওয়া চাল দিয়ে আটা প্রস্তুত করে বিভিন্ন রকম পিঠা পুলি তৈরি করেছেন। যার সুঘ্রান একদম আতপ চালের মত।
[১১] এক প্রশ্নের জবাবে সাঞ্জু জানান, এটি বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। প্রতিদিন ২০ কেজি বীজ সংগ্রহ করা যায়। এসব পরিষ্কার করে ভাঙিয়ে দানা বের করলে ধানের সমপরিমাণ চাল হয়। তার কাছে এখন বাঁশ ফুলের দানা থাকলেও চাল নেই। অন্তত ৫০ জন তার কাছে চালের জন্য বলে রেখেছেন। অনেকে আগাম টাকা দিয়ে রেখেছেন। প্রথম দিকে এই চাল ৪০ টাকা কেজি বিক্রি হলেও চাহিদার সঙ্গে দামও বেড়েছে। এখন তিনি ৭০ টাকা কেজি করে চাল বিক্রি করবেন বলে জানান।
[১২] ওই এলাকার মিল মালিক জাকির হোসেন বলেন, তার মিলে বাশ ফলের দানা নিয়ে এসে ভাঙ্গিয়ে নিয়ে গেছেন সাঞ্জু রায়। তিনি তার কাছ থেকে চাল নিয়ে ভাত ও পায়েশ রান্না করে খেয়েছি। খুব সুস্বাদু।
[১৩] এ বিষয়ে ফুলবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রুম্মান আক্তার বলেন, এটি গবেষণার বিষয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান কোনো কৃষিপণ্য সার্টিফাই করলে, তখন আমরা সেই বিষয়ে সম্প্রসারণের কাজ করি।
[১৪] ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) আঞ্চলিক কার্যালয় রংপুরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. রকিবুল হাসান জানান, বাঁশের বীজ থেকে চাল উৎপাদন হয় এই প্রথম জানলাম। দেশের কোথাও এমন ঘটনা শোনা যায়নি। এটি একটি বিরল ঘটনা। বিষয়টি নিয়ে আমরা শিগগিরই গবেষণার কাজ শুরু করব।
[১৫] দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক নুরুজ্জামান জানান,বাঁশ এবং ধান একই প্রজাতির। ৫০ বছরে একটি বাঁশ ঝাড়ে একবার ফলের আসে। পরে আর সেই বাঁশ ঝাড়টি টিকে থাকেনা। তবে বাঁশ ফলের সেই দানা থেকে অবিকল চালের মত দানা হয়। যার ভাতের স্বাদ ধানের চালের ভাতের মতই। তবে এটি সম্ভাবনা ময় নয়।
প্রতিনিধি/একে
আপনার মতামত লিখুন :