ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন : ভারতকে নিজেদের অতিথি করে পেতে কত চেষ্টাই না করেছে পাকিস্তান। ভিভিআইপি নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি, দরকারে ম্যাচ খেলেই নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগসহ কত সুবিধার প্রস্তাব নিয়েই না হাজির হয়েছিল! কিন্তু পাকিস্তানের আয়োজনে হওয়া চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে আতিথ্য নিতে রাজিই হলো না ভারত! রাজনৈতিক-কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে ভারত তাদের দল পাকিস্তানে পাঠাতে রাজি হয়নি, আইসিসি উপায় না পেয়ে টুর্নামেন্টটা পাকিস্তানের আয়োজনেই করলেও ভারতের ম্যাচগুলো দুবাইয়ে রেখে ‘হাইব্রিড মডেলে’ করতে বাধ্য হলো।
সেই দুবাইয়ে আজ ভারত আর পাকিস্তান যখন মুখোমুখি, পাকিস্তানের সামনে ভারতকে দেখিয়ে দেওয়ার চেয়েও বড় সমীকরণ ছিল, ম্যাচটা জিতে টুর্নামেন্টে টিকে থাকা। কিন্তু তা আর হলো কই! পাকিস্তানের অতিথি না হওয়া ভারত উল্টো পাকিস্তানকে হেসেখেলে ৬ উইকেটে হারিয়ে দিল, তাতে নিজ ঘরে আয়োজিত টুর্নামেন্টে পাকিস্তানই এখন দর্শক বনে যাওয়ার পথে।
পাকিস্তানের ভাগ্য এখন অনেকটাই বাংলাদেশের হাতে। আগামীকাল রাওয়ালপিন্ডিতে বাংলাদেশ যদি নিউজিল্যান্ডকে হারাতে না পারে, বাংলাদেশ আর পাকিস্তান দুই দলেরই বিদায় নিশ্চিত হয়ে যাবে। আর যদি বাংলাদেশ কাল জিতে যায়, সে ক্ষেত্রেও অবশ্য পাকিস্তানের ভাগ্য অনেক যদি-কিন্তুর ওপর নির্ভর করবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিপক্ষে ২৭ ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিন্ডিতেই নিজেদের জয় নিশ্চিত তো করতে হবেই, পাকিস্তানকে এই আশায়ও থাকতে হবে যে – নিউজিল্যান্ড যাতে ভারতের কাছে হেরে যায়। শুধু এতটুকুই নয়, এত সব হিসাব মিলে গেলেও তখন রানরেটের হিসাব করতে হবে পাকিস্তান, বাংলাদেশ আর নিউজিল্যান্ডকে।
আজ টস জিতে আগে ব্যাটিং নিয়ে পাকিস্তান যখন ২৪১ রানে গুটিয়ে গেল, তখনই পাকিস্তান সমর্থকদের অস্বস্তি শুরু হয়ে গেছে। বল ধরে আসে, এমন পিচেও যে এই রান ভারতের এমন ব্যাটিং লাইনআপের সামনে খুব একটা বড় নয়। এই লক্ষ্যটাই মামুলি হয়ে গেল ভিরাট কোহলি, শ্রেয়াস আইয়ারদের সামনে। ফর্মে থাকা শুবমান গিল চল্লিশের ঘরে (৪৬) আউট হয়েছেন, আইয়ার করেছেন ফিফটি (৫৬), কিন্তু খুশদিল শাহকে চার মেরে ৪৫ বল হাতে রেখেই ভারতের জয় যখন নিশ্চিত করে দিচ্ছেন কোহলি, তাঁর ব্যাট উঁচিয়ে ধরার উপলক্ষ্যও তৈরি হয়ে গেল। ওই চারের আগে কোহলির রান যে ছিল ঠিক ৯৬!
ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৫১তম সেঞ্চুরির ইনিংসটার শুরুই কোহলি করেছেন একটা রেকর্ড গড়ে – ওয়ানডেতে দ্রুততম ১৪ হাজার রানের! মাইলফলক থেকে ১৫ রান দূরে থেকে ইনিংসটাতে নেমেছিলেন কোহলি। তাঁর সিগনেচার বনে যাওয়া পাঞ্চ কাভার ড্রাইভে ইনিংসে নিজের প্রথম চারেই সে দূরত্ব ঘুচিয়ে দিলেন তিনি। ১৪ হাজারের ঘরে পৌঁছানো কোহলির ওয়ানডেতে এটি ২৮৭তম ইনিংস। এর আগে রেকর্ডটা যাঁর ছিল, তিনি কোহলিরই আদর্শ শচীন টেন্ডুলকার, ভারতীয় কিংবদন্তির ১৪ হাজারে পৌঁছাতে লেগেছিল ৩৫০ ইনিংস। আজ তালিকার তিন নম্বরে চলে যাওয়া কুমার সাঙ্গাকারার লেগেছিল ৩৮৭ ইনিংস।
লেগ স্পিনে সাম্প্রতিক সময়ে কোহলি ভুগছেন, কিন্তু আজ অষ্টম ওভারেই ক্রিজে নামা কোহলির সামনে পাকিস্তান লেগ স্পিনার আবরারকে এনেছে ইনিংসের ১২তম ওভারে। আবরারকে শেষ পর্যন্ত ভালোভাবেই সামলেছেন কোহলি, যদিও ব্যাটের ফেইস ওপেন করে খেললেও তাঁর শরীরের ভর বদলে সময় একটু বেশি লাগছে, সেটা সাদা চোখে ধরাও পড়ছে। ২৫ রানে থাকার সময়ে আবরারের একটা বল নিচু হয়ে যাওয়ায় ইনসাইড এজ হলেও কোনো বিপদ হয়নি কোহলির। এর বাইরে পেসটা তো কোহলির সব সময়ই পছন্দ, একাদশ ওভারে রউফের একটা বলে ক্যাচ দিয়েও বেঁচে যাওয়ার বাইরে আর তেমন ভুগতে হয়নি তাঁকে।
রউফের সে বলটা কোহলির ব্যাটের কানায় লেগে থার্ডম্যানের দিকে ক্যাচ গিয়েছিল, তবে সেখানে থাকা ফিল্ডার নাসিম শাহর বেশ সামনেই পড়েছে। এর পরের বলেই অবশ্য পাকিস্তানের ফিল্ডিংয়ের চিরাচরিত দুর্বলতা – ক্যাচ মিস দেখা গেছে। শর্ট মিডউইকেটে ক্যাচ দিয়েছিলেন ফর্মে থাকা শুবমান গিল, কিন্তু সে সময়ে ৩৫ রানে থাকা গিলের ক্যাচটা ধরতে পারেননি খুশদিল।
গিল অবশ্য এরপর বেশিদূর এগোতে পারেননি, পাকিস্তানের এতে যদি কিছুটা স্বস্তি মেলে। ১৮তম ওভারে আবরারের অসাধারণ বাঁক নেওয়া ক্যারম বলে গিলের স্টাম্প যখন ছত্রখান, তাঁর নামের পাশে রান ৪৬।
তবে গিল যখন আউট হচ্ছে, ততক্ষণেই ভারতের রান ঠিক ১০০। লক্ষ্য যখন মাত্র ২৪২, সে পথে মাত্র ১৭.৩ ওভারেই ১০০ রানে পৌঁছে যাওয়া বলছিল, ভারত কতটা আরামে এগোচ্ছে। শাহিন আফ্রিদির অসাধারণ ইনসুইঙ্গিং ইয়র্কারে বোল্ড হওয়ার আগে রোহিত ১৫ বলে করেছেন ২০ রান। পঞ্চম ওভারের শেষ বলে রোহিত আউট হওয়ার সময়ে ভারতের রান ছিল ৩১।
এরপর কোহলির স্বচ্ছন্দ্য ব্যাটিংয়ের সঙ্গে ফর্মে থাকা গিল মিলে ভারতকে দ্রুত ১০০ পার করিয়েছেন। গিল ফিরলেও ভারতের ছন্দে তেমন ব্যাঘাত হয়নি। নতুন ব্যাটসম্যান শ্রেয়াস আইয়ার কিছুটা ভুগেছেন হারিস রউফের সুইং করা আর না করা বলের ব্যবধানে, তবে সেটা অস্বস্তি ছাড়িয়ে বিপদ পর্যন্ত যায়নি।
শেষ পর্যন্ত তৃতীয় উইকেটে কোহলির সঙ্গে আইয়ারের ১১৪ রানের জুটি ভারতের জয় বলতে গেলে নিশ্চিতই করে দিয়েছে। ৫৬ রান করে খুশদিলের বলে ক্যাচ দিয়ে আইয়ার যখন আউট হচ্ছেন, ভারত জয় থেকে মাত্র ২৮ রান দূরে। হার্দিক পান্ডিয়া বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি, তবে ভারতের সমর্থকদের তখন আর ওসব নিয়ে পরোয়াও নেই। তখন শুধু একটাই হিসাব – জয়ের আগে কোহলির সেঞ্চুরিটা দেখা যাবে তো!
পান্ডিয়া যখন আউট হচ্ছেন, ভারত তখন জয় থেকে ১৯ রান দূরে, কোহলির সেঞ্চুরির জন্য দরকার ১৪ রান। ছয়ে নামা আকশার প্যাটেল ‘অ্যাসাইনমেন্ট’টা বুঝে নিয়ে শুধু সিঙ্গেল নিয়ে কোহলিকে স্ট্রাইকে এনেছেন। ৪২তম ওভারের পঞ্চম বলে ভারতের যখন ৫ রান দরকার, আর স্ট্রাইকে থাকা কোহলির রান ৯৪, গ্যালারি থেকে কোরাস উঠল – উই ওয়ান্ট সিক্সার!
সে আশা পূরণ হলে শেষটা আরও চোখধাঁধানো হতো। তা হয়নি, শেষ বলে সিঙ্গেল নিয়ে স্ট্রাইক রাখলেন কোহলি। সেঞ্চুরির আশা তখনো উজ্জ্বল। কিন্তু খুশদিলের করা পরের ওভারের প্রথম বলে আবার যখন সিঙ্গেল নিলেন কোহলি, গ্যালারিতে উশখুশ। এই বুঝি সেঞ্চুরিটা হলো না! কিন্তু আকশার পরের বলেই সিঙ্গেল নিয়ে আবার স্ট্রাইকে আনলেন কোহলিকে। ৯৬ রান নিয়ে স্ট্রাইকে কোহলি, ভারতের দরকার ৩ রান। একটা চার হলেই তো ল্যাটা চুকে যায়!
চুকিয়ে দিলেন কোহলি! খুশদিলের বল এল, দু পা এগিয়ে এসে কাভারে উড়িয়ে মারলেন কোহলি, বল চলে গেল সীমানার বাইরে…ভারতের উচ্ছ্বাস সব দিক থেকে পরিপূর্ণ!