স্পোর্টস ডেস্ক: ইসরায়েলের হামলায় প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষের রক্তে রঞ্জিত ফিলিস্তিনের রাজপথ। যে দেশে কয়েক দিন পর পর ইসরায়েলের বর্বর হামলায় মৃত্যু ঘটে শিশু থেকে শুরু করে আবাল বৃদ্ধবনিতার। এখন পর্যন্ত ৪৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালগুলো ধ্বংসাবশেষে পরিণত হওয়ায় চিকিৎসার অভাবে ধুঁকছেন লাখো গাজাবাসী।
ক্ষুধার জ্বালায় কাতরাচ্ছে সেখানকার শিশু, নারী, পুরুষ সবাই। কারণ খাদ্য সহায়তা ঢুকতে দিচ্ছে না ইসরায়েলি বাহিনী।
আবাসিক ভবনগুলো হামলায় বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ায় এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোও গামলার শিকার হওয়ায় শহরে নিরাপদ স্থান বলে কিছু নেই। ফলে আশ্রয়হীন অবস্থায় আছেন সেখানকার অধিকাংশ জীবিত বাসিন্দা। সেখানে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সব ঘটনার কিছু চিত্র প্রকাশ্যে আসার পর তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে ইসরায়েল ও তার মিত্ররা বাদে বাকি সব দেশের মানুষ।
গাজা তথা ফিলিস্তিনে এমন ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মাঝে খেলাধুলার প্রসঙ্গ তোলাই হয়তো হাস্যকর মনে হতে পারে। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা বাকি বিশ্বের চেয়ে একটু আলাদা। যুদ্ধের ক্ষত বুকে নিয়েই জন্ম হয় তাদের। অসীম সাহসী এই জাতি ধ্বংসস্তুপের মধ্যে থেকেও জেগে ওঠতে জানে। মহাশক্তিশালী শত্রুর বিপক্ষে হার না মেনে লড়তে জানে। কংক্রিটের ধ্বংসস্তূপে ভরা ভূমিতে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে পারে ২০২৬ বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন! অদ্ভুত জাতিই বটে!
ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে দাঁড়িয়েও দেশের জনগণের স্বার্থে বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে চায় ফিলিস্তিনি ফুটবল দল। প্যালেস্টানিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (পিএফএ) প্রেসিডেন্ট এমনটাই জানিয়েছেন। তবে স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে যে বিশাল পার্থক্য, সেটিও জানেন তিনি। কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকা এবং যুদ্ধের কারণে গাজা থেকে খেলোয়াড় আনা সম্ভব হচ্ছে না। এসব ব্যাপারে শক্ত অবস্থান নিচ্ছে না ফিফা। এমনকি ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ করার আহবানেও এখন পর্যন্ত সাড়া দেয়নি বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
আসলে ফিলিস্তিনে যা চলছে, তা নিয়ে পুরো দুনিয়াটাই উদাসীন। তাদের রক্ষায় এগিয়ে আসছে না আশেপাশের কোনো আরব দেশ কিংবা বিশ্বের কোনো পরাশক্তি। শুধু ইরান ও তাদের সমর্থিত কয়েকটি গোষ্ঠী সীমিত আকারে যুদ্ধে জড়িয়েছে। কিন্তু তাতে গাজা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। লাশের পর লাশ পড়ছে প্রতিদিন।
দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ইসরায়েলি নির্যাতনের জবাব দিতে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা করে গাজার নিয়ন্ত্রকগোষ্ঠী হামাসের সশস্ত্র যুদ্ধারা। হামলায় প্রায় ১২ শ ইসরায়েলির মৃত্যু হয়। এছাড়া ২৫০ জনকে জিম্মি হিসেবে নিয়ে যায় হামাস যোদ্ধারা। সেই হামলার প্রতিশোধ নিতে ওই দিন থেকেই গাজা উপত্যকায় তা-ব শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী।
সেই যুদ্ধ এখনও চলমান। যে যুদ্ধে বহু ফিলিস্তিনি ফুটবলারের মৃত্যু হয়েছে। এমনকি দেশটির শীর্ষ পর্যায়ে খেলা কয়েকজন ফুটবলারও হামলায় নিহত হয়েছেন। ধ্বংস হয়েছে স্টেডিয়াম, ক্লাব থেকে অনেক অবকাঠামো। সবধরনের খেলাই বন্ধ। এরমধ্যেও স্থানীয়ভাবে ফুটবল আয়োজনের চেষ্টা দেখা যায়। কয়েকজন তরুণ মিলে শরণার্থীশিবিরে ফুটবল ম্যাচ আয়োজন করেছিলেন সেখানকার তরুণ ফুটবলাররা। স্বাভাবিক জীবন ও স্বজন হারানোর অসম্ভব বেদনা বুকে নিয়ে তারা ফুটবলে মেতে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু জীবন সংশয়ে থাকায় সেগুলো চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না। আর তাতে অঙ্কুরেই ধ্বংস হচ্ছে শত শত ফুটবল প্রতিভা।
এতকিছুর মধ্যেও ফুটবল বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন কিভাবে দেখছে ফিলিস্তিনি ফুটবল দল? উত্তরটা কিছুটা বোঝা যাবে পিএফএ প্রধান জিব্রিল রাজুবের কথায়। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোতে বসতে চলা বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন নিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে তিনি বলেছেন, আমাদের চলাফেরা বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে, ইসরায়েলের শ্বাসরুদ্ধকর নীতি সবকিছু পঙ্গু করে দিয়েছে। আমরা জাতীয় লিগ থেকে শুরু করে সব বাতিল করতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু এতকিছুর পরেও আমরা বিশ্বকাপসহ সব প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
কিন্তু এরপরেই সমস্যার কথাও বললেন পিএফএ প্রধান, 'আমাদের সমস্যার অন্ত নেই। কারণ আমরা গাজা থেকে কোনো খেলোয়াড় (পশ্চিম তীরে) আনতে পারছি না। (যুদ্ধে) অনেকের মৃত্যু হয়েছে। গাজার ক্লাব, স্টেডিয়াম তথা সব ক্রীড়া অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। পশ্চিম তীরেও (ইসরায়েলি বাহিনী) আমাদের শ্বাস রুদ্ধ করছে, আমরা কিছুই করতে পারছি না। কিন্তু এটা (বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করা) আমাদের সংকল্প, আমাদের অঙ্গীকার।
ইসরায়েলি বর্বরতা থেকে রেহায় পাচ্ছে না দখলকৃত পশ্চিম তীরও। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মকর্তাদের দেওয়া বরাতে জানা গেছে, দখলদার বাহিনীর হাতে পশ্চিমতীরে এখন পর্যন্ত ৭৪৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গত অক্টোবরে জাতিসংঘ জানিয়েছিল, গত এক বছরে পশ্চিমতীরের ১৬৫ জন শিশুকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। অঞ্চলটির অনেক জায়গা জবরদখল করেছে তারা। স্বাভাবিকভাবে চলাফেরার সুযোগও সীমিত করে রাখা হয়েছে।
এ অবস্থায় ফিলিস্তিনের বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ আসলে কতটুকু? ফিলিস্তিন এমনিতে মাঝারি মানের ফুটবল দল। বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু আগামী বিশ্বকাপ হবে ৪৮ দলের। যে কারণে ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসরে খেলার স্বপ্ন দেখছে ফিলিস্তিন। বাছাইপর্বে অবশ্য তেমন আশা জাগানিয়া ফল পায়নি তারা। চার ম্যাচে মাত্র ২ পয়েন্ট অর্জন করে গ্রুপ 'বি'র একদম নিচে অবস্থান তাদের।
সামনে অবশ্য ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে ফিলিস্তিন। আগামী ১৪ নভেম্বর তারা মাস্কাটে খেলবে স্বাগতিক ওমানের বিপক্ষে। এর ৫ দিন পর তারা মোকাবিলা করবে দক্ষিণ কোরিয়ার। দ্বিতীয় ম্যাচটির আয়োজন ফিলিস্তিন। কিন্তু প্রায় ৫ বছর আগে সর্বশেষ ঘরের মাঠ জেরুসালেমে আন্তর্জাতিক ফুটবল আয়োজন করেছিল পিএফএ। নিজেদের মাঠে আয়োজন না করতে পারায় দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটি জর্ডানের রাজধানী আম্মানেই খেলবে তারা।
পরের মাঠে হোম ম্যাচ আয়োজন করা নিয়ে রাজুব বলেন, 'এটা কখনোই ঘরের মতো হবে না। আমরা জর্ডানকে পছন্দ করি, আম্মানকেও; কিন্তু আমরা জেরুসালেমে খেলতে পছন্দ করি, আমরা আমাদের ঘরে খেলতে চাই, কিন্তু আমাদের উপায় নেই। এটা আর্থিকভাবেও প্রায় অসম্ভব। তবে এবার প্রথমবার ঘরের কাছে জর্ডানে খেলতে যাচ্ছি। আশা করি ফিলিস্তিনি সমর্থকরাও সেখানে খেলা দেখতে আসবে। আমরা আয়োজক। আমাদের অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াতে হবে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে। আমাদের আর কোনো উপায় নেই।
ফিলিস্তিনের ফুটবল যে অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে আছে, তা থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করা। ২০২২ বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দল কমপক্ষে ৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। ফিলিস্তিনের জন্য এই পরিমাণ অর্থ অনেক বড় ব্যাপার। যা অর্জনের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তারা। বাছাইয়ের তৃতীয় পর্বে আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর মতো ফলও পেয়েছে তারা। গ্রুপ পর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই তারা শতিশালী দক্ষিণ কোরিয়াকে (০-০) রুখে দেয়। গত মাসে তারা কুয়েতের সঙ্গেও ড্র করেছে।
বিশ্বকাপের মূল পর্বে জায়গা পেতে আরও কঠিন লড়াই লড়তে হবে ফিলিস্তিনকে। শীর্ষ দুইয়ে থাকা প্রায় অসম্ভব। তবে তৃতীয় বা চতুর্থ হয়ে গ্রুপ পর্ব শেষ করলে প্লে অফ খেলার সুযোগ পাবে তারা। এজন্য ওমানের সঙ্গে পয়েন্টের ব্যবধান ঠিক রাখতে হবে তাদের। এখন পর্যন্ত চারে থাকার ওমান মাত্র ১ পয়েন্ট পিছিয়ে আছে। এই লড়াইয়ের জন্য কতটা প্রস্তুত ফিলিস্তিনি? জবাবে রাজুব বলেন, আমি মনে করি, আমাদের দল ভালো খেলছে। এত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা ইতিহাসে প্রথমবার বাছাইয়ের তৃতীয় রাউন্ডে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছি।
আমাদের কোনো জাতীয় লিগ নেই, ফলে এটা এত সহজ নয়। অনেক খেলোয়াড় মারা গেছে, কিংবা তাদের সতীর্থ বা কোচের মৃত্যু হয়েছে। এসব নিশ্চয়ই খেলোয়াড়দের মনের ওপর প্রভাব ফেলে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা ভালো খেলার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এটা আমাদের খেলোয়াড়দের জন্য প্রেরণা হিসেবে কাজ করতে পারে।
জিব্রিল রাজুব বললেন বটে, ফিলিস্তিনের জন্য কাজটা মোটেই সহজ নয়। - আল জাজিরা, রয়টার্স, বাংলানিউজ
আপনার মতামত লিখুন :