দৈনিক আমার দেশ'র প্রতিবেদন।। কারাগারে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করছেন দরবেশখ্যাত সালমান এফ রহমান। তিনি সব সময় চিল্লাচিল্লি করেন। কারারক্ষীদের সঙ্গে মাস্তানি করেন শাজাহান খান। কথায় কথায় রাজাকারের বাচ্চা বলে গালি দিচ্ছেন হাসানুল হক ইনু।
অ্যাডভোকেট আনিসুল হক সবাইকে শোনাচ্ছেন আশার বাণী- ড. ইউনূস সরকার নাকি বেশিদিন নেই, তারা মুক্তি পেয়ে যাচ্ছেন। আর সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক সেলে শুধুই কাঁদেন। সেলে গান গেয়ে সময় কাটে পলকের। আর সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুন বই পড়েন।
এভাবেই কারাগারের চার দেয়ালে জীবন-যাপন করছেন আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও বিভিন্ন পর্যায়ের বন্দি নেতারা। কারাগার সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এদের অনেকেই মোবাইল ফোন ম্যানেজ করে আত্মীয়-স্বজন ও নিজেদের বিশস্ত লোকদের সঙ্গে কথা বলেন। অনেকেই বাইরে থেকে উন্নত খাবার কিনে খান। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মন্ত্রী, শীর্ষ নেতা ও এমপিরা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান।
ভিআইপি বন্দিদের মধ্যে রয়েছেন ফ্যাসিস্ট হাসিনার বেসামরিক ও শিল্প-বাণিজ্য উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, বরখাস্ত হওয়া বিতর্কিত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, সাবেক তথ্য-প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ। কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন ৬৭ জন ও গাজীপুরের কাশিমপুরের ৪টি কারাগারে রয়েছেন ৫৮ জন। এই ৫টি কারাগারে রয়েছেন মোট ১২৫ জন। এর মধ্যে ১২২ জন পুরুষ ভিআইপি ও ৩ জন মহিলা ভিআইপি বন্দি। বাকি ২০ জন ভিআইপি বন্দিকে খুলনা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামের কারাগারে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই ডিভিশন পাননি। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এখন পর্যন্ত ৪১ জন ডিভিশন পেয়েছেন। ডিভিশনপ্রাপ্তরা কারা নিয়ম অনুযায়ী আলাদা কক্ষ পান।
নিয়ম অনুযায়ী তাদের প্রত্যেকের জন্য একজন সেবক নিয়োগ করে কারা কর্তৃপক্ষ। তবে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়া ভিআইপিদের নিয়ে বহুমুখী বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে কারা কর্তৃপক্ষকে। একাধিক ভিআইপি বন্দির উগ্র আচরণ, কারা নিয়ম না মানা, জেল থেকে আদালতে যাওয়ার সময় পুলিশের ওপর আক্রমণাত্মক কথা বলা, টিভি দেখতে চাওয়া, অতিরিক্ত সংবাদপত্র চাওয়া, অতিরিক্ত সেবা চাওয়া ও নিজের মতো করে থাকতে চাওয়া নিয়ে বেকায়দায় আছে কারা কর্তৃপক্ষ। কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের নিয়ম অনুযায়ী যে সেবা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে ভিআইপি বন্দিদের সেই সেবা দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে তাদের যাওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই।
এ বিষয়ে কারা অধিদপ্তরের সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন) জান্নাত-উল-ফরহাদ আমার দেশকে জানান, ‘সারা দেশের কারাগারে ১৪৫ জন ভিআইপি আছেন। কারা নিয়ম অনুযায়ী ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের সেবা দেওয়া হচ্ছে।’
কারাগার সূত্রে জানা গেছে, কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দি রয়েছেন সালমান এফ রহমান, হাসানুল হক ইনু, আনিসুল হক, রাশেদ খান মেনন, শাজাহান খান, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, ইমরান আহমেদ, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান, আসাদুজ্জামান নূর, নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, আরিফ খান জয় ও ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী।
এছাড়াও ড. আবদুর রাজ্জাক, সাধন চন্দ্র মজুমদার, দীপু মনি, তাজুল ইসলাম, র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, ফরহাদ হোসেন, শামসুল হক টুকু, সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম, বরখাস্ত হওয়া বিতর্কিত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, এ বি তাজুল ইসলাম, জুনাইদ আহমেদ পলক, আওয়ামী লীগের নেতা অ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার, একাধিক ব্যাংকের মালিক নজরুল ইসলাম মজুমদার, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও টিপু মুনশি বন্দি রয়েছেন।
তাছাড়াও মাহবুব আরা বেগম গিনি, বিতর্কিত সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, সাবেক মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান, নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত, সাবেক এমপি কামাল আহমেদ মজুমদার, হাজী সেলিম, সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন, আহমেদ হোসেন, সাদেক খান, বি এম ফজলে করিম চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সাবেক অফিস সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপ, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) সংস্থার সাবেক পরিচালক কমোডর মনিরুল ইসলাম, ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের বরখাস্ত হওয়া সাবেক ডিসি মশিউর রহমান, বরখাস্ত হওয়া ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ হিল কাফী, পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ও শহীদুল হক।
কারাগার সূত্র জানায়, একাধিক ভিআইপিকে নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ বিড়ম্বনার মধ্যে আছেন বলে জানা গেছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের জন্য আলাদা সেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। একেকটি রুমকে একেকটি সেল বলা হয়ে থাকে। কোনো একটি সেলে তিনজন থাকেন। আবার একটি সেলে দুজন থাকতে পারেন। সেখানে আলাদা করে একটি চৌকি, কম্বল, বালিশ এবং মগ, থালা ও বাটি দেওয়া হয়ে থাকে। ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের জন্য আলাদাভাবে রান্না করা হয়ে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী তাদের দুটি পত্রিকা সরবরাহ করা হয়। এক সেলের সঙ্গে আরেক সেলের কোনো যোগাযোগ নেই। মুখ উল্টো দিকে। অন্য সেলে যেতে হলে মাঠ দিয়ে ঘুরে যেতে হয়।
কারা সূত্রে জানা গেছে, কারাগারে যাওয়ার পর গোলাপ সেলের একটি কক্ষে ছিলেন হাসিনার বেসামরিক ও শিল্প বাণিজ্য উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। কিন্তু দুজনের সঙ্গে সালমানের বনিবনা হয়নি। সালমান ওই কক্ষে সেবকদের নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে চিল্লাপাল্লা করেন। তার সবকিছুতে চাহিদা বেশি।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি ফোনে কথা বলতে গিয়ে কারারক্ষীদের নজরে আসেন। এ নিয়ে ওই সেলে হইচই পড়ে যায়। কারা সূত্র জানিয়েছে, সেলে থাকা দুই বন্দি রাজ্জাক ও ফারুক কারা কর্তৃপক্ষকে বলেছেন যে, যাতে তাদের অন্য সেলে পাঠানো হয়। পরে সালমানকে অন্য সেলে পাঠানো হয়েছে। কারা সূত্র জানিয়েছে, সেলের মধ্যে টিভি দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। সালমান এ নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে একটি আবেদন করেন। কিন্তু, তার আবেদন খারিজ করে দিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।
সূত্র জানায়, ভিআইপি বন্দি সাবেক আইজিপি ও জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড আবদুল্লাহ আল মামুন ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম গোলাপ সেলের পাশের একটি সেলে রয়েছেন। মামুনকে তার স্ত্রী অনেক বই সরবরাহ করেছেন। সারাদিন তার পড়াশোনা করেই কাটে। আর সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক কারাগারে ভেঙে পড়েছেন। তিনি প্রায় সময় বিষণ্ণ মনে থাকেন বলে কারারক্ষীরা জানিয়েছে। কখনো কখনো তিনি সেলের মধ্যে বসে কাঁদেন।
সূত্র জানায়, আরেক ভিআইপি বন্দি শাজাহান খানকে নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ বিড়ম্বনার মধ্যে রয়েছেন। কারাগার থেকে গাড়িতে ওঠা পর্যন্ত তিনি হ্যান্ডক্যাপ পরতে চান না। পুলিশকে গালিগালাজ করেন। কাউকে তিনি রাজাকারের বাচ্চা বলেও গালি দেন।
সূত্র জানায়, আরেক ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দি পলক সেলে অধিকাংশ সময়ই গান গেয়ে সময় কাটান। তার সঙ্গে সেলে আছেন সাবেক মুক্তিযোদ্ধা প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম। কারাগার থেকে যখন আদালতে যান তখন সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে বিভিন্ন উক্তি করে ভাইরাল হওয়ার চেষ্টা করছেন।
কারা সূত্রে জানা গেছে, ভিআইপি বন্দিরা কারাগারে যাওয়ার পর প্রথমে কিছুটা খোশমেজাজে থাকলেও দিন দিন তাদের বিষণ্ণতা বাড়ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কারারক্ষী জানান, ‘সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তাকে বলেছেন যে, বেশিদিন তিনি কারাগারে থাকবেন না। ড. ইউনূস সরকার বেশিদিন ক্ষমতায় থাকবে না।’
কারা সূত্র জানিয়েছে, ডিএমপির বরখাস্ত হওয়া সাবেক ডিসি মশিউর রহমান সাধারণ হাজতিদের সঙ্গেই রয়েছেন। তিনি কারাগারে বোর্ডে হাজতি-কয়েদিদের ইংরেজি ক্লাস নিয়ে থাকেন।