মহনির কবির: ডিসেম্বরে নির্বাচন করতে আদায়ে সোচ্চার হয়েছে বিএনপি। নেতাদের বক্তব্য ডিসেম্বর ছাড়া জুনে নির্বাচন সম্ভব নয়, কারণ ফেব্রুয়ারিতে রোজা, দুই ঈদ এরপর বর্ষাকাল এসময়ে জাতীয় নির্বাচন করা সম্ভব নয়। কিন্তু অন্তর্বতী সরকার বাব বার বলছে ডিসেম্বর-জুন নির্বাচনের কথা।
তাই ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের দাবি আদায়ে জনমত গঠন করতে যাচ্ছে বিএনপি। এজন্য সমমনা রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনার অংশ হিসেবে শনিবার ১২ দলীয় জোট ও এলডিপির সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। বৈঠকে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনে উভয় পক্ষ একমত হয়েছে বলে বৈঠক শেষে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। রোববার বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
জানা গেছে, প্রত্যাশিত সময়ে নির্বাচন না দিলে দীর্ঘদিন ধরে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে যারা আন্দোলনে ছিলেন, তাদের সবাইকে নিয়ে রাজপথে নামার ইঙ্গিত আছে বাম জোটের নেতাদের বক্তব্যে। তবে বিএনপি মনে করে, এখনই আন্দোলন নয়। সবার সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ইতিপূর্বে বিএনপির সঙ্গে যেসব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বৈঠক করেছে, তারাসহ আরও কিছু দল বিএনপির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বৈঠক করবে বলে জানা গেছে।
শনিবার জাতীয় নির্বাচন, সংস্কার এবং ফ্যাসিস্টদের বিচারসহ নানা ইস্যুতে ১২ দলীয় জোট ও লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটি। বৈঠকে প্রত্যেক দলের পক্ষ থেকে নিজস্ব কর্মসূচি পালন এবং জনমত গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বৈঠকে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে একমত হয়েছেন নেতারা। তাদের দাবি- ডিসেম্বরের মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচন করা সম্ভব। বিগত ১৬ বছর ধরে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি। এই মুহূর্তে জনগণ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রত্যাশা করে। এ জন্য দ্রুততম সময়ে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে বর্তমান সরকারকে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দিতে হবে। তার আগে নির্বাচনী রোডম্যাপ চান দল ও জোটের শীর্ষ নেতারা। তারা আরও বলছেন- অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফসল। রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনের সরকার। তাই নির্বাচনের দাবিতে এখনই আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা দেখছেন না বৈঠকে অংশ নেওয়া দলগুলো। তবে তাদের অভিন্ন দাবিতে জনমত গঠনে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বৈঠক থেকে।
বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে প্রত্যেক দলের নেতারা মনে করছেন- চলতি বছরের ডিসেম্বরই নির্বাচনের উপযুক্ত সময়। বিলম্ব হলে ফ্যাসিস্টরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। দেশ নিয়ে দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র হতে পারে। তাই সবাই চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন ও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ, তাদের দোসর এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিষয়ে একমত পোষণ করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে বিএনপিসহ গণতন্ত্রমনা অন্যান্য দল ও তাদের নেতাদের নিয়ে বিভিন্ন অপপ্রচার চলছে। সে সব প্রতিরোধে সবাইকে সচেতন থাকার পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বৈঠকে প্রত্যেক দলের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে একটি কনভেনশন আকারে নির্বাচনের দাবি উত্থাপনের বিষয়ে আলোচনা করেন নেতারা। তবে এ বিষয়ে এখনই কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে। ঘাপটি মেরে থাকা প্রশাসনের দোসরদের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হওয়ার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে বৈঠক থেকে।
বৈঠক শেষে লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, অনেক বিষয়ে একমত হয়েছে বিএনপি। সরকার ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছে। কিন্তু আমরা চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চাই। ফ্যাসিস্ট দল আওয়ামী লীগের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হওয়া উচিত বলে মনে করেন সবাই। তিনি বলেন, নির্বাচনের দাবিতে এখনই আন্দোলনের প্রয়োজন দেখছে না বিএনপি। কারণ, এই সরকারকে তো আমরা সমর্থন দিয়ে বসিয়েছি।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, কয়েকদিন আগে প্রধান উপদেষ্টার এবং তার সহকর্মীদের সঙ্গে বিএনপির একটা আলোচনা হয়েছে। সেই আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়েই আমরা আজকে মতবিনিময় করেছি। এ ব্যাপারে আরও রাজনৈতিক জোট এবং দলের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হবে। বৈঠকে নির্বাচনের বিষয়ে কী ধরনের সিদ্ধান্ত হয়েছে- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সবেমাত্র আমাদের আলোচনা শুরু হয়েছে। বাকি জোট ও যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
১২ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা ও জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, আমরা একটি বিষয় লক্ষ করেছি যে, প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যে অটল রয়েছেন। কিন্তু আমাদের দাবি হচ্ছে- ডিসেম্বরের মধ্য নির্বাচন করতে হবে। দেশবাসীর প্রত্যাশাও একই।
বৈঠকে বিএনপির পক্ষে আরও উপস্থিত ছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান। ১২ দলীয় জোটের পক্ষে আরও উপস্থিত ছিলেন- বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম, বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব গোলাম মহিউদ্দীন ইকরাম প্রমুখ। এলডিপির মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের প্রতিনিধি দল বৈঠকে অংশ নেয়।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স সাংবাদিকদের জানান, বিএনপির সঙ্গে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা হয়। কিছু দিনের মধ্যে তিনি দেশের বাইরে যাবেন, তাই রবিবার (আজ) বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করে যাবেন। এর ২ দিন আগে আমাদের সময়কে নির্বাচনের বিষয়ে তিনি জানিয়েছিলেন, নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যে না দিয়ে সরকার যেন জনগণ ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি না করে। এমনটা হলে তারা তাদের সহযোগীদের নিয়ে আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবেন। তবে তার বিশ^াস সরকার তাদের আন্দোলনে নামাতে বাধ্য করবে না।
গণতন্ত্রমঞ্চের নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক জানান, বিএনপি থেকে তাদের কাছে সময় চাওয়া হয়েছে। তারাও বৈঠকের বিষয়ে আন্তরিক। শিগগিরই বৈঠক হবে। এ ছাড়াও বেশকিছু ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে বিএনপির এ সপ্তাহেই বৈঠক হবে বলে জানা গেছে।