এল আর বাদল ; মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই দুই মাসে দেশে রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ১০৪টি৷ এইসব সংঘাতে নিহত হয়েছেন ১৬ জন৷
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে সংঘাত, সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে৷ এসব ঘটনায় প্রাণহানীও হয়েছে৷ জামায়াতসহ অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও তাদের সংঘাতের খবর পাওয়া গেছে৷ বছরের প্রথম দুই মাসের পরিসংখ্যানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জড়িত শিক্ষার্থীদের নিজেদের মধ্যকার কয়েকটি সংঘাতের তথ্য উঠে এসেছে৷ তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কোথাও কোথাও সংঘাতে জড়াচ্ছে। - সূত্র, ডয়েচেভেলে
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই দুই মাসে মোট ১০৪টি রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা নথিবদ্ধ করেছে৷ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এরমধ্যে বিএনপি নেতাকর্মীদের নিজেদের মধ্যে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে ৫৬ টি, যা মোট ঘটনার অর্ধেকেরও বেশি৷ আর বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ৭৬টি৷ এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১০ জন, আহত হয়েছেন ৮৫৪ জন৷ শুধু বিএনপির নিজেদের মধ্যে সংঘাতে আহত হয়েছেন ৬৪৬ জন, নিহত সাত জন৷ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজনৈতিক সংঘাতের ৭৩ ভাগেরও বেশি হচ্ছে বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনের মধ্যে৷
এই সময়ে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে আটটি, এতে আহত হয়েছেন ১২৯ জন৷ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে ৮৫টি৷ তিনজন আহত এবং একজন নিহত হয়েছেন৷ ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের মধ্যে তিনটি সংঘর্ষের ঘটনায় ১৮ জন আহত হয়েছেন৷ ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের, যুবদল ও যুবগলীগ এবং বিএনপি ও শ্রমিক লীগের মধ্যে একটি করে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে৷
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জড়িত শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে পাঁচটি সংঘর্ষে জড়িয়েছে৷ এইসব ঘটনায় ২০ জন আহত হয়েছেন৷ এছাড়াও পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একটি করে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র৷
২০২৪ সালে ৬৪৯টি রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনায় মারা যান ১০০ জন৷ আর চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মিলিয়ে গত ১৪ মাসে সংঘাতের ৭৫৩টি ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১১৬ জন৷
-- সংঘাতের কারণ আধিপত্য--
দেশের কয়েকটি এলাকায় কথা বলে জানা গেছে, বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘাত বেড়ে যাওয়ার কারণ স্থানীয় পর্যায়ে আধিপত্য৷ রাজনৈতিক গ্রুপিং-এর আধিপত্যের সঙ্গে আছে দখলদারি৷ অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাদের নেতা-কর্মীদের দখলে যা ছিলো বিভিন্ন স্থানে তা এখন বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা দখলে নিচ্ছেন৷ আর তা নিয়েই নিজেদের নেতা-কর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ঘটনা ঘটছে৷
সর্বশেষ রোববার সকালে পাবনার ইশ্বরদীতে বাসস্ট্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে এক বিএনপি নেতা গুলিবিদ্ধসহ সাত-আটজন আহত হয়েছেন৷ এমনকি বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিনবাদে নেতানিয়াহুর কুশপুত্তলিকা পোড়ানো নিয়ে নাটোরের বড়াইগ্রামে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে শনিবার ১০ জন আহত হয়েছেন৷ বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে এই সংঘর্ষ হয়েছে বলে জানা গেছে৷
বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহের পাগলা থানার কান্দিপাড়া বাজারে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়েছে৷ এই সংঘর্ষে স্থানীয় বিএনপি, ছাত্রদল ও যুবদল জড়িয়ে পড়ে৷ এতে আট জন আহত হন৷ স্থানীয় পর্য়ায়ে কথা বলে জানা যায় কান্দিপাড়া বাজারের ইজারার নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই সংঘর্ষ হয়৷
একই দিনে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলায় বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ২০ জন আহত হন৷ এখানেও রাজনৈতিক আধিপত্য ও বাজারে মহড়া দেয়া নিয়ে সংঘাত হয়৷
ভোলার বিএনপির তৃণমূলের নেতা আল ইমরান জানান, আওয়ামী লীগ চলে যাওয়ার পর তাদের দখলে থাকা বিভিন্ন কিছুর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিএনপির মধ্যে সংঘাত হচ্ছে৷ তিনি বলেন, ‘‘মনোনয়ন প্রত্যাশীরা নানা গ্রুপ গড়ে তোলায়ও সংঘাত বাড়ছে৷”
একই ধরনের কখা বলেন বাগেরহাটের একজন নেতা আব্দুস সালাম৷ তিনি বলেন, ‘‘স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপি অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন৷ তাদের মধ্যে দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে৷ এর কারণ হলো আধিপত্য এবং সামনের নির্বাচন৷
-- মানবাধিকার সংস্থার পরিসংখ্যান তথ্যভিত্তিক নয়: বিএনপি
নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি গঠনের পর কম হলেও তাদের সঙ্গে সংঘাত হচ্ছে বিএনপি এবং সহযোগী সংগঠনের৷ ২৪ মার্চ হাতিয়ায় এনসিপির সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষ হয়েছে৷ এতে এনসিপি নেতা আব্দুল হান্নান মাসউদসহ ৩০ জন আহত হন৷ ওই সংঘর্ষের পর এনসিপি এক বিবৃতিতে দাবী করে স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির ওপর নিয়ন্ত্রণ নাই কেন্দ্রের৷
তবে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্সের অভিযোগ , বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটলেও গণমাধ্যম সেগুলোকে বড় করে দেখাচ্ছে৷ তিনি বলেন, ‘‘ব্যক্তিগত বিরোধ, জমিজমা দখলের ঘটনাকেও তারা বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ হিসাবে দেখাচ্ছে৷ তিনি দাবি করেন, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা যে পরিসংখ্যান দিচ্ছে তা সঠিক তথ্যভিত্তিক নয়৷
বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘তারপরও আমরা সতর্ক আছি৷ যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাচ্ছি ব্যবস্থা নিচ্ছি৷ বহিষ্কার করছি৷''
পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন ,"আমরা তো সরকারে নাই৷ পুলিশ কোনো অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিতে পারে মামলা নিতে পারে৷ অভিযুক্তদের আটক করতে পারে৷তবে বিএনপির এই নেতার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিস হোসেন প্রিন্স৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা ১২ আগস্ট যখন প্রধান উপদেষ্টার সাথে দেখা করি৷ তখন বলেছিলাম ৫ আগস্টের গণভ্যুত্থান কোনো দলের বিজয় নয়৷ তাই আমরা বলেছিলাম সব জায়গায় দলীয় প্রভাবমুক্ত লোকজনকে বসাতে৷ ফলে কোনো দল তারা জয়ী হয়েছে বলে আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে না৷ কিন্তু সেটা হয়নি৷ ফলে এখন আমরা দাখলদারি ও পাল্টা দখলদারি দেখতে পাচ্ছি৷”
তিনি বলেন, ‘‘বিএনপি যতই অস্বীকার করুক, যতই বলা হোক ব্যস্থা নেয়া হচ্ছে, বাস্তবে তাদের আধিপত্য ও দখল-পাল্টা দখলের লড়াই চলছে৷ তারা এখন নিজেরাই নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে৷ আওয়ামী লীগ আগে এই কাজ করেছে৷ তাদের ফেলে যাওয়া অবস্থানে এখন বিএনপি ঢুকেছে৷
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জাহেদ উর রহমানের মতে, ‘‘পতিত সরকারের যে চাঁদবাজির একটি কালো অর্থনীতি ছিলো বিএনপি সেটার দখল নিতে চাইছে৷ দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন আসনে বিএনপির ১০-১২ জন করে সম্ভাবনাময় প্রার্থী আছে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য৷ তারা নিজেরা প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে৷ ফলে এই সংঘাতগুলো হচ্ছে৷ একটি কারণ অর্থনৈতিক এবং আরেকটি অভ্যন্তরীণ রাজনীতি৷
এক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ড. জাহেদ উর রহমানও৷
তিনি বলেন, ‘‘বিএনপি এখন ক্ষমতায় নাই ফলে এটা তার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন৷ সরকারের এখানে দায়িত্ব আছে৷ পুলিশের দায়িত্ব আছে৷