জনগণ পাঁচ বছরের জন্য অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে চায়—অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টার এমন মন্তব্যের সমালোচনা করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিনআহমদ। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচিত সরকারের বিকল্প তো আপনারা হতে পারেন না। আপনারা অবশ্যই অনির্বাচিত। সেটা প্রতিদিন আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে।’
আজ রোববার বিকেলে ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে ভাসানী অনুসারী পরিষদের ‘জাতীয় প্রতিনিধি সম্মেলন ২০২৫’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলে সালাহ উদ্দিনআহমদ। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘গণতন্ত্রের কথা বলে আপনারা গণতন্ত্রের উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করবেন, নির্বাচনের কথা বলে নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করবেন—এটা কি গণতন্ত্রের জন্য শুভ? এটা কি গণ–অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ছিল? এটা কি গণ–অভ্যুত্থানের জন–আকাঙ্ক্ষা ছিল?’
উপদেষ্টাদের বক্তব্যের সমালোচনা করে সালাহ উদ্দিনআহমদ বলেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিতে প্রধান উপদেষ্টা যখন প্রতিশ্রুত, নির্বাচনের জন্য বিএনপি রোডম্যাপ দাবি করছে, তখন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপদেষ্টা পর্যন্ত বক্তৃতা দিতে শোনা যায় যে জনগণ নাকি তাদের পাঁচ বছরের জন্য চায়। ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা...। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ চেয়ে আমরা বহু কমেন্ট দেখেছি, সেটা উনি দেখেননি?’
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টার একটি বক্তব্যেরও সমালোচনা করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য। তিনি বলেন, ‘কালকে আমাদের ফরিদা আপা একজন উপদেষ্টা...আমার সঙ্গে খুবই ভালো সম্পর্ক, সে জন্য আমি সমালোচনা কম করতে চাই। বললেন, উনারা নাকি নির্বাচিত হয়েছেন। কীভাবে? গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উনাদের নির্বাচিত করেছে জনগণ? তাহলে এ দেশে নির্বাচন কমিশন আছে কেন?’
এ প্রসঙ্গে সালাহ উদ্দিন আহমদ আরও বলেন, ‘যদি রাস্তার গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তন হয়, সেটা অবশ্যই এ দেশের মানুষের কামনা। কিন্তু একটা নির্বাচিত সরকারের বিকল্প তো আপনারা হতে পারেন না। আপনারা অবশ্যই অনির্বাচিত। সেটা প্রতিদিন আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে।’
এ সময় কবি–চিন্তক ফরহাদ মজহারের একটি বক্তব্যেরও সমালোচনা করেন সালাহ উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘উনার (ফরিদা আখতার) স্বামী আমাদের ভাই ফরহাদ মজহার সাহেব দু–তিন দিন আগে বক্তব্য দিয়েছেন, নির্বাচনের মাধ্যমে নাকি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় না। কেবল লুটেরাদের একটা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়। কী আর বলব!’
যে নির্বাচনের জন্য, যে ভোটাধিকারের জন্য, যে গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য, যে সাংবিধানিক অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য এ দেশের হাজার মানুষ শহীদ হলেন, গণ–অভ্যুত্থান হলো, ফ্যাসিবাদের পতন হলো—সেই নির্বাচন, সেই ভোটাধিকারকে আপনারা অস্বীকার করছেন বলে মন্তব্য করেন সালাহ উদ্দিন আহমদ। তিনি প্রশ্ন করে বলেন, ‘কাদেরকে আপনারা উৎসাহিত করছেন? কোন অগণতান্ত্রিক শক্তিকে এই মাঝপথে আপনারা সুবিধা দিচ্ছেন? কাদের সুবিধা দেওয়ার জন্য, কাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য প্রধান উপদেষ্টা প্রায়ই ডিসেম্বরে থেকে জুন, ডিসেম্বর–জুন–ডিসেম্বরে আসা যাওয়া করছেন? এক জায়গায় স্থির থাকতে পারছেন না কেন?’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘আপনি পৃথিবীবিখ্যাত একজন সম্মানিত ব্যক্তি। আপনার এই রকম শিফটিংটা (নির্বাচন নিয়ে ডিসেম্বর ও জুন–সম্পর্কিত বক্তব্য) কিন্তু জাতি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভালোভাবে নেবে না।’
এ প্রসঙ্গে সালাহ উদ্দিন আহমদ আরও বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে আপনারা বৈঠক করেছিলেন। কথা দিয়েছিলেন। আপনাদের সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে ডিসেম্বরকে সামনে রেখে জাতীয় নির্বাচনের উদ্দেশ্যে। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বসেছি, কথা বলেছি। তাঁদের সব নির্বাচনের প্রস্তুতি আগামী জুন মাসের ভেতরে সমাপ্ত হবে। তাঁরা বলেছেন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার জন্য উদ্গ্রীব।’
অনুষ্ঠানে এক–এগারোর প্রসঙ্গ নিয়েও কথা বলেন সালাহ উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক রকমের অভিজ্ঞতা আছে। তিক্ত অভিজ্ঞতা। যাঁরা ওয়ান–ইলেভেন করেছেন, তাঁরাও অনেক রকমের কথা বলে বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় দুই বছর ছিলেন। সেই ওয়ান–ইলেভেনের মইনুদ্দীন–ফখরুদ্দীনের কথা আপনাদের মনে নেই? বিরাজনীতিকরণের জন্য যথেষ্ট চেষ্টা তাঁরা করেননি? আমি বলতে চাই না সে রকম কোনো পদক্ষেপ বর্তমানে দৃশ্যমান হচ্ছে, কিন্তু আমরা ঘরপোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পাই।’
বাংলাদেশের মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য, সাংবিধানিক অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এক দফার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ দেশে গণতান্ত্রিক গণ–অভ্যুত্থান, ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান সৃষ্টি করেছিল বলে উল্লেখ করেন সালাহ উদ্দিন আহমদ।
এই বিএনপি নেতা বলেন, ‘কেউ যদি এটাকে বিপ্লব বলতে চায়, তাহলে আমি দুঃখ প্রকাশ করব। এটা কোনো সামাজিক বিপ্লব নয়। অর্থনৈতিক ও সামাজিক রীতিনীতি ও ব্যবস্থা পরিবর্তনের বিপ্লব হয়নি। গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা থেকে গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একটি গণতান্ত্রিক গণ–অভ্যুত্থান, ছাত্র–গণ–অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে।’
সে কারণে গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পেতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ দেশে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চান বলে উল্লেখ করেন বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই, আমাদের সংবিধান যেটা রোগাক্রান্ত হয়েছে, সেই সংবিধানকে যথাযথ সংস্কারের মধ্য দিয়ে, অধিকতর সংস্কারের মধ্য দিয়ে সংশোধনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রকাঠামো সংশোধনের মধ্য দিয়ে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সংবিধান পেতে চাই, যে সংবিধানের ভিত্তিতে আমাদের দেশ একটি ভারসাম্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা পাবে এবং আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটবে দেশের মানুষের জন্য।’
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান (মান্না), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক প্রমুখ। ভাসানী অনুসারী পরিষদের ‘জাতীয় প্রতিনিধি সম্মেলন ২০২৫’–এর মাধ্যমে সংগঠনটির নাম পরিবর্তন করে ‘ভাসানী জনশক্তি পার্টি’ করা হয়। এর চেয়ারম্যান করা হয়েছে ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলামকে। আর আবু ইউসুফ সেলিমকে মহাসচিব করা হয়েছে। উৎস: প্রথম আলো।