কালেরকন্ঠ প্রতিবেদন: সম্প্রতি জামায়াত ইসলামী ও শিবিরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সতর্ক পর্যবেক্ষণ করছে বিএনপি। অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতৃত্বর কর্মকাণ্ডে তাদের ওপর ইতিবাচক মনোভাবের পরিবর্তন হতে শুরু করেছে বিএনপির। তবে তারপরও পিঠ দেয়ালে ঠেকে না যাওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ও সহনশীলতা দেখিয়ে যাবেন বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এই দু’পক্ষের সঙ্গে বিরোধে জড়াতে চান না তারা। তবে দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর বেলায় ভিন্ন কৌশল নিয়েছে বিএনপি।
তাদের এখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভেবেই এগোচ্ছে দলটি।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে যেকোনো ধরনের বিরোধ ও সহিংসতা এড়িয়ে চলতে চান তাঁরা। কারণ, বিএনপির নেতাকর্মীরা সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে মাঠে নামলে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, যার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে তৃতীয় পক্ষ।
দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দুজন নেতার সঙ্গে আলাপকালে তাঁরা বলেন, অতিপ্রয়োজনীয় ন্যূনতম সংস্কার এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে সরকারের পাশেই আছে বিএনপি।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘সম্মান ও মর্যাদা’ অক্ষুণ্ন রেখেই নির্বাচন আদায় করতে চান তাঁরা। তাই সরকারের ওপর রাজনৈতিক চাপ তৈরি করলেও তাঁর প্রতি অসম্মান হোক—এমন কিছুই করছেন না তাঁরা।
একইভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কিংবা জাতীয় নাগরিক কমিটির কার্যক্রমেরও সমালোচনা করছে বিএনপি। তবে সেটি সংঘাতে জড়ানোর মতো পরিস্থিতি নিতে চাইবে না তারা।
নির্বাচন, সরকারের সুবিধা নিয়ে গঠন এবং গণ-অভ্যুত্থানের আন্দোলনের কৃতিত্ব নিয়ে বৈষম্যবিরোধীদের বক্তব্যে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা কমে এসেছে তাদের।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারের ত্রুটি বিচ্যুতির সমালোচনা করা মানেই তাদের অসহযোগিতা করা নয়। আমরা তাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সময় বলে দেবে, নির্বাচনের দাবিতে বিএনপিকে কঠোর হতে হবে কি না।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন প্রশ্নে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে গত ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে জেলা পর্যায়ে সমাবেশ শুরু করেছে বিএনপি।
এর মাধ্যমে দেশে একটি নির্বাচনী আবহও তৈরি করতে চায় তারা। পাশাপাশি রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা নিয়ে কর্মশালা করে যাচ্ছে, যাতে বিএনপির এই উদ্যোগের বিষয়ে জনগণের মধ্যে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করা যায়।
বিএনপির কর্ম-কৌশল প্রণয়নে যুক্ত একজন নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, রমজানের আগেই সমাবেশ শেষ হবে। আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে দলের কেন্দ্রীয় বর্ধিত সভা হবে। রমজানে নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ ও ইফতারকেন্দ্রিক রাজনীতিতে ব্যস্ত থাকবেন দলের নেতাকর্মীরা। এরই মধ্যে রমজান-পরবর্তী পরিকল্পনা চূড়ান্ত করবেন দলের নীতিনির্ধারকরা।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হবে বলে প্রধান উপদেষ্টা তাদের আশ্বস্ত করেছেন। তাঁর এই বক্তব্যে বিএনপি আশ্বস্ত। তবে নির্বাচন নিয়ে সরকারসংশ্লিষ্ট অন্য পক্ষগুলোর নেতিবাচক মনোভাব আছে। ফলে শেষ পর্যন্ত সরকার তার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান দলটির নীতিনির্ধারকরা। সে জন্য রাষ্ট্র সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকারকে সহযোগিতা করে রোডম্যাপ আদায় করতে চায় বিএনপি।
বিএনপি নেতাদের অনেকে মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে একটি পক্ষ দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে চায়। এ ক্ষেত্রে তাঁরা গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকা ছাত্র নেতাদের উদ্যোগে নতুন দল গঠন প্রক্রিয়ার দিকে ইঙ্গিত করছেন। সরকারে থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দল গঠন করা হচ্ছে বলে বিএনপি থেকে অভিযোগও করা হচ্ছে।
গতকাল বিএনপির একাধিক নেতা সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বুধবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারের উপদেষ্টাদের দায়িত্বে থাকা ছাত্র নেতাদের কার্যক্রমের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘তাঁরা সরকারে থেকে তাঁদের দল গোছানোর জন্য বিভিন্ন রকম কৌশল নিচ্ছেন। তাঁরা এখন নিজেদের স্বার্থে ওই ফ্যাসিস্টদের জায়গা দিতে চান। সেই কৌশল নিলে আমরা তা হতে দেব না, দেশের মানুষ তা হতে দেবে না।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘অবশ্যই যখন নতুন রাজনৈতিক দল গঠন হবে, তাকে আমরা স্বাগত জানাব। ছাত্রসংগঠন এরই মধ্যে করেছে, আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। তার মানে এই নয় যে আপনারা সরকারে বসে, সরকারের সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দল গঠন করবেন, সেটা কখনোই মেনে নেওয়া হবে না, জনগণ মেনে নেবে না।’
বিএনপির অন্যতম সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল নেতারা বলছেন, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) সংঘর্ষের ঘটনা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এ জন্য গতকাল সংবাদ সম্মেলনে দুঃখ প্রকাশ করেছে সংগঠনটি। আবার সমালোচনাও করেছে বৈষম্যবিরোধী ও ছাত্রশিবিরের। তাঁরা দাবি করেন, সংঘর্ষের জন্য ছাত্রশিবির দায়ী। এই সংগঠনটি গুপ্ত রাজনীতি করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নামে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করেছে।
ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছি। আরো ধৈর্য ধরব। আমরা কোনো বিরোধে জড়াতে চাই না।’
জামায়াতের বিষয়ে কৌশল ভিন্ন : ৫ আগস্টের পর বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের বিরোধ তৈরি হয়। গণ-অভ্যুত্থানের পর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবেন না—এমন বক্তব্য দিয়েছেন। সেই বক্তব্য নিয়েও বিএনপির মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। মূলত তখন থেকে দুই দলের মধ্যে বাগযুদ্ধ শুরু। সময়ের মিত্র দুই দল এখন একে অপরকে প্রতিপক্ষ বলে মনে করে। এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও দখলদারির অভিযোগ তুলছে।
বিএনপি মনে করছে, ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে দেশের প্রেক্ষাপট বদলের পর জামায়াত নিজেরাই ক্ষমতাপ্রত্যাশী হয়ে উঠেছে। ক্ষমতায় যাওয়ার প্রত্যাশা থেকে তারা বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছে। জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বের রাজনৈতিক নেতাদের মনোজগতের এই পরিবর্তন বিএনপির নেতৃত্বকে কৌশলী হতে বাধ্য করছে।
সংবিধান সংস্কার, স্থানীয় সরকার নির্বাচন, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ এবং আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনের প্রশ্ন সামনে এলে জামায়াত ও বিএনপিতে ভিন্ন অবস্থান প্রকাশ পায়। তা ছাড়া বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চাইলেও জামায়াত সরকারকে সময় দিতে চায়। অর্থাৎ দ্রুত নির্বাচন চায় না জামায়াত।
বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় কেউ কাউকে ছাড় দেবে না। জামায়াতের সমালোচনায় মুখর থাকবে বিএনপি। তাদের সঙ্গে যে বিরোধ তৈরি হয়েছে, তা সমাধানের পথেও থাকবে না দলটি।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, অঙ্গীকার রক্ষা করা এবং কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও জামায়াত সেই অবস্থানে নেই। এটি একটি মুনাফেকি দল। বিএনপির সঙ্গে সরকারে থেকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে এখন তারা বিরুদ্ধে কথা বলছে। তাদের নিজেদের অবস্থান বোঝা উচিত। ইতিহাসের প্রতিটি ক্ষণে তারা জনগণের সঙ্গে বেঈমানি করেছে। ৫ আগস্টের পরও তা-ই করছে। এটাই জামায়াতের চরিত্র।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, অতীতে বিএনপির সঙ্গে থেকে জামায়াতের কোনো লাভ হয়নি।
দুই দলের নেতাদের বক্তব্যে স্পষ্ট, ভিন্ন রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে দুই দল। রাজনীতিতে শেষ কথা না থাকলেও আপাতত তাদের মধ্যে সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
আপনার মতামত লিখুন :