মহসিন কবির: ডিসেম্বরে নির্বাচন টার্গেট করে দল গোছাচ্ছে বিএনপি। ইতোমধ্যে নিজেদের মধ্যে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগে জাতীয় নির্বাচন চায় বিএনপি।
অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) তারা ইতিমধ্যে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে বিএনপি। স্থানীয় নির্বাচন বিএনপি কেন আগে চাচ্ছে না, এ বিষয়ে শীর্ষ নেতারা বড় দাগে তিনটি কারণের কথা জানিয়েছেন।
দলটির নেতাদের মতে, এর প্রধান কারণ দলীয় প্রতীকবিহীন স্থানীয় নির্বাচন আগে হলে পতিত ফ্যাসিবাদ ফিরে আসার জন্য একে বড় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজে লাগাতে পারে। এতে দেশ জুড়ে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। যেটি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এটি সরকারের যে মূল ফোকাস জাতীয় নির্বাচন, সেই প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করতে পারে।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, নানামুখী ষড়যন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে অবিলম্বে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই হতে পারে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ।
গত শনিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা খুব পরিষ্কারভাবে বলেছি জাতীয় নির্বাচন আগে; তারপর স্থানীয় সরকার নির্বাচন।’ গতকাল স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল মাহমুদ টুকু বলেছেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো অন্তর্বর্তী সরকার এসে এই ধরনের নির্বাচন করেনি। আমরাও স্থানীয় নির্বাচন চাই না; আগে জাতীয় নির্বাচন (চাই)।’ দলের জ্যেষ্ঠ মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘শেখ হাসিনা ভয়ংকর পরিকল্পনা নিয়ে ওঁৎ পেতে আছে। দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দিয়ে সেই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে হবে।’
দ্বিতীয় কারণ হলো জামায়াতের কর্মকান্ড। বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারকের মতে, ইতিমধ্যে জাতীয় সংসদের বিভিন্ন আসনে জামায়াত দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করছে। দলটির এমন তৎপরতায় আস্থার অভাব ও সন্দেহ বেড়েছে বিএনপিতে। তাই স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে দল দুটি। বিএনপি জাতীয় নির্বাচন আগে চাইলেও জামায়াত আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাচ্ছে।
বিএনপির এক শীর্ষ নেতা জানান, তাদের ধারণা বিএনপি যাতে নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী না হতে পারে সে জন্যই জামায়াত ‘নির্বাচন প্রলম্বিত করতে’ নানা ধরনের তৎপরতা শুরু করেছে। কারণ গত ১৭ বছর নানা কারণে জামায়াতের সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল হয়েছে। স্থানীয় নির্বাচন আগে হলে জামায়াত তাদের সংগঠনকে শক্তিশালী করার একটা প্ল্যাটফর্ম পাবে।
তৃতীয় কারণ হিসেবে বিএনপি নেতারা ছাত্রদের নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়াটি সামনে এনেছেন। বিএনপির মধ্যে আলোচনা হচ্ছে ছাত্রদের দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হলেও সারা দেশে এখনো তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি নেই। আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে তাদের সাংগঠনিক প্রক্রিয়া খুব একটা ভিত্তি পাবে না। ফলে জাতীয় নির্বাচনে তাদের প্রার্থী থাকলেও প্রস্তুতিতে ঘাটতি থাকবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় নির্বাচন হলে সারা দেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে তারা প্রার্থী ঘোষণা করবে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের একটি সাংগঠনিক ভিত্তি দাঁড়িয়ে যাবে। তাদের এই সুযোগ ফ্যাসিবাদীরা, জামায়াতসহ সবাই নেওয়ার সুযোগ খুঁজবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে চলতি বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানানো হয়েছিল। তবে সম্প্রতি রাজনৈতিক অঙ্গনে জাতীয় নির্বাচন আগে না স্থানীয় নির্বাচন আগে হবে সেটি নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। এর পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে। গত ১ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেওয়া ‘নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন’-এর প্রতিবেদনেও জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার।
নির্বাচন কমিশনও এ বিষয়ে সিদ্ধান্তহীন অবস্থায় রয়েছে। গত সপ্তাহে ইউএনডিপিসহ উন্নয়ন সহযোগী ১৮টি দেশের রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, ‘দুটো নির্বাচন একসঙ্গে করা যায় কি না, এতে কেমন সময় লাগতে পারে, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সবকটি স্থানীয় সরকারের নির্বাচন ধাপে ধাপে করতে গেলে এক বছর সময় লেগে যায়। পুরোপুরি এভাবে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করতে হলে জাতীয় নির্বাচনের সময় পিছিয়ে যাবে। জাতীয় নির্বাচন এখন নির্বাচন কমিশনের অগ্রাধিকার। নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচন নিয়েই এ মুহূর্তে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের, সেটা সেভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এটা সরকারের সিদ্ধান্ত।’
বিএনপি গত মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিল, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে তাদের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত হচ্ছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কোনো প্রশ্নই আসে না। কারণ, এখন পুরো দেশ ও জাতির ফোকাসটা হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন না চাওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করে দলটি তখন বলেছিল, সংকটটা ওই জায়গাতে, দেশে গত তিনটি জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি। মানুষ সেজন্য একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ পাড়ি দিতে চায়। তাছাড়া স্থানীয় সরকার দেশ চালায় না। দেশ চালায় জাতীয় সংসদ, আইন প্রণয়ন করে জাতীয় সংসদ। ফলে গণতন্ত্রের মূল বিষয়টি হচ্ছে জাতীয় সংসদ, এটা কার্যকর হলে গণতন্ত্র সচল হয়। বিএনপি তখন এও জানিয়েছিল, স্থানীয় সরকারের তৃণমূল স্তর হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ। সেই ইউনিয়ন পরিষদই তো সরকার এখনো বাতিল করেনি। সেটা যদি বাতিল না করে, সেখানে কীভাবে লোকাল গভর্নমেন্ট নির্বাচন হবে?
সপ্তাহ দুই আগে যমুনায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে নিজেদের আপত্তির কথা পুনরায় জানিয়েছে বিএনপি। গত শনিবারও যমুনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিটির সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন নয়।’ গত সপ্তাহে ইসির সঙ্গে বৈঠকেও এমন মনোভাবের কথা জানিয়েছে বিএনপি।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘তারা গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, যেটি সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে স্থানীয় নির্বাচনের কথা মাথায় আনা যাবে না। কারণ, পতিত আওয়ামী লীগ গর্তের ভেতর মাথা লুকিয়ে রেখেছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে তারা গর্ত থেকে মাথা বের করবে, আবারও মাথাচাড়া দেবে। তাই আওয়ামী লীগকে সেই সুযোগ দেওয়া যাবে না।’
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদও এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন না চাওয়ার বিষয়টি আমাদের দলীয় নীতিগত সিদ্ধান্ত। আইনি এবং সাংবিধানিক বিষয়াবলি বিবেচনায় নিয়ে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমরা যদি অগ্রাধিকার ঠিক না করি, দেশে একটি ব্যাপক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। তা ছাড়া দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই মানুষ দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। দেশে এই ধরনের সরকারের অধীনে অতীতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের নজির নেই।
এদিকে রোববার সকালে জিয়ার মাজারে নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার নেতাকর্মীদের নিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে রিজভী আরও বলেন, ‘জাতি এখন অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে। ইউনূস সরকার নির্বাচন দিতে গড়িমসি করছে। যে গণতন্ত্রের জন্য এত জীবন গেল, সেই গণতন্ত্র ফেরাতে ভোটের জন্য চূড়ান্ত ডেডলাইন দিতে হবে এই সরকারকে।’