এল আর বাদল : বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর ৫ অগাস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বেশ কয়েকবার অডিও লিঙ্কের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে তার সমর্থকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বক্তব্যের গুরুত্ব বিবেচনা করে বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দেশের গণমাধ্যম তার ভাষণ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
এই প্রচার আটকাতে গত বছর ৫ ডিসেম্বর হস্তক্ষেপ করে আদালত। হাসিনার বক্তব্য গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করার উপর ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নিষেধাজ্ঞা থাকায়, তার বক্তব্য বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশ করা নিয়ে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। - ভয়েস অফ আমেরিকা
তবে আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, আদালতের আদেশ নিয়ে তারা মোটেই বিচলিত নন। দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলছেন, সরকার নির্দিষ্ট কিছু জায়গা বন্ধ করতে পারলেও, তারা সারা দুনিয়ার গণমাধ্যমকে বন্ধ করতে পারবে না।
বাংলাদেশের মানুষের সচেতনতা যে স্তরে আছে, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে তারা পৃথিবীর কোথায় কি হচ্ছে, তার খোঁজ খবর রাখেন, তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন। বাংলাদেশর মানুষই বিকল্প পথ ও জায়গাগুলো বেছে নেবেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরদের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত গত ৫ ডিসেম্বর হাসিনার ঘৃণাসূচক বক্তব্য নিষিদ্ধ করার আদেশ দেয়। হাসিনার যেসব বক্তব্য ইতোমধ্যে ইলেক্ট্রনিক এবং সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে সেগুলো সরিয়ে ফেলার আদেশও দেয় আদালত।
আওয়ামী লীগ নেতারা ট্রাইব্যুনালের আদেশ কোন আদালতের নির্দেশ হিসেবে দেখতে রাজী নন। দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এবং সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত বলছেন, এই আদেশে কিচ্ছু যায় আসে না।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তো কিছু না, এটা তো ইউনূস সরকার করেছে, আরাফাত ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন। “তারা কি বললো সেটাতে তো কিচ্ছু যায় আসে না। বরং এটা বলে তারা একটা নজির রাখলো যে, তারা মুখে ডেমোক্রেসির কথা বলে, কিন্তু আসলে তাদের অবস্থান এগুলোর বিরুদ্ধে, তিনি বলেন।
বাহাউদ্দিন নাছিম বলছেন, গত অগাস্ট-এর পট পরিবর্তনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বতীকালীন সরকার যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে, সেটা নিয়ে বিতর্ক আর প্রশ্ন আছে। তিনি বলেন, এই আদালত রাজনৈতিক ও অশুভ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য গঠন করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটররা বলেন যে, হাসিনার বক্তব্য তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার সাক্ষীদের জন্য হুমকিস্বরূপ। ঢাকার দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আল নোমানকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, হাসিনার যেসব বক্তব্য এখন সামাজিক মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো জাতিসংঘের রাবাত প্ল্যান অফ অ্যাকশনের আওতায় পড়ে।
জাতিসংঘের রাবাত প্ল্যান অফ অ্যাকশনের লক্ষ্য হচ্ছে কোন জাতি, বর্ণ বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণাসূচক প্রচারণার মাধ্যমে বৈষম্য বা সহিংসতার উস্কানি রোধ করা। এর মাধ্যমে মানুষের বাক স্বাধীনতার অধিকার আর ঘৃণাসূচক বক্তব্যের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়েছে।
জাতিসংঘ ‘ঘৃণাসূচক’ বক্তব্যর ক্ষেত্রে ব্যাপক বা বিস্তৃত সীমারেখা বা থ্রেশহোল্ডের কথা বলেছে, যে সীমারেখা অতিক্রম না করা পর্যন্ত বক্তব্যকে ‘ঘৃণাসূচক’ বলা যাবে না। সেটা যাচাই করার জন্য ছয়টি বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে, যার প্রথম হচ্ছে প্রেক্ষাপট - অর্থাৎ, নির্দিষ্ট কোন বিবৃতি কোন বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য, শত্রুতা বা সহিংসতার প্ররোচনা দেয় কি না, সেটা যাচাই করার জন্য সেসময়ের রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করতে হবে।
অন্যান্য বিষয়গুলোর মধ্যে আছে, বক্তা কে এবং তার বক্তব্য কাদের উদ্দেশ্যে করা, বক্তব্যর উদ্দেশ্য, বিষয়বস্তু, প্ররোচনা সৃষ্টি করতে বক্তব্যটির সম্ভাবনা কতটুকু,ইত্যাদি। শেখ হাসিনার কোনও বক্তব্য নির্দিষ্ট জাতি, বর্ণ বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণাসূচক প্রচারণা কি না, তা ট্রাইব্যুনালকে নির্ধারণ করতে হবে রাবাত প্ল্যান অফ অ্যাকশনে নির্ধারিত ছয়টি বিষয়ের আলকে।
যেকোন বক্তব্যকে ‘ঘৃণাসূচক’ হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য রাবাত প্ল্যান অফ অ্যাকশনের সীমারেখা বা থ্রেশহোল্ড যেহেতু খুবই বিস্তৃত, তাই হাসিনার কোন ভাষণ বা বিবৃতি তার আওতায় পড়ে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পর্যবেক্ষকরা।
ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান, যিনি বহু বছর ধরে বাংলাদেশে আইনের শাসন এবং মানবাধিকার নিয়ে গবেষণা করছেন, বলছেন যে, হাসিনার বক্তব্য ভুয়া তথ্যে ভরপুর থাকলেও সেগুলো, তার দৃষ্টিতে, জাতিসংঘের সীমারেখার ধারে কাছ দিয়েও যায় না।
হাসিনার কোন ভাষণ কি কোন ‘নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর’ প্রতি ‘বিদ্বেষ, শত্রুতা এবং ঘৃণার মত তীব্র এবং অযৌক্তিক আবেগ’ প্রদর্শন করে বৈষম্য, শত্রুতা বা সহিংসতার ‘আসন্ন’ ঝুঁকি সৃষ্টি করছে, বার্গম্যান গত ৫ ডিসেম্বর সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ প্রশ্ন তোলেন।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতারা বিষয়টি আইনগত ভাবে না বিশ্লেষণ করে আদালতের আদেশকে দলের নেত্রী এবং আদর্শের উপর আক্রমণ হিসেবে দেখছেন। বাহাউদ্দিন নাছিম অভিযোগ করেন যে ট্রাইব্যুনালকে “রাজনৈতিক ও অশুভ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য গঠন করা হয়েছে।
তাদের এই আদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের জায়গা থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে, জাতির পিতার আদর্শকে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে পিছিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র কখনই সফল হবে না, তিনি বলেন।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটররা মনে করেন হাসিনার বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলোর সাক্ষীদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য এই আদেশের প্রয়োজন ছিল। গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম বলেন, সম্প্রতি হাসিনার কিছু ফাঁস হওয়া টেলিফোন আলাপ এবং ভাষণে কিছু শব্দ ব্যবহার করা হয়েছিল যা ছিল সাক্ষীদের জন্য হুমকিস্বরূপ।
এ’ধরনের বক্তব্য যদি প্রচার এবং প্রকাশ করা হয়, তাহলে আমরা বিচারের সময় সাক্ষীদের ট্রাইব্যুনালে আনতে পারবো না, মনোয়ার হোসেনকে উদ্ধৃত করে দ্য ডেইলি স্টার জানায়।
বার্গম্যানের মত পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন এই আদেশের একমাত্র ফল হবে যে, এর কারণে বাংলাদেশের মিডিয়া হাসিনার ভাষণ রিপোর্ট করতে ভয় পাবে - যা হবে আওয়ামী লীগ আমলের পুনরাবৃত্তি, যখন বিরোধী দল বিএনপি’র নেতা তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল।
আপনার মতামত লিখুন :