বাংলা ট্রিবিউন প্রতিবেদন : বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে ভারত সম্পর্কে একটা খুব পুরনো অভিযোগ—তারা সে দেশে ‘সব ডিম একই ঝুড়িতে রাখে’– অর্থাৎ কিনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভারত ভরসা করে শুধু আওয়ামী লীগকেই। মজার ব্যাপার হলো, ভারতের কর্মকর্তারাও যে এই বক্তব্যটা খুব একটা অস্বীকার করেন তেমন নয়, এবং কেন শুধু আওয়ামী লীগেই তাদের আস্থা, তার হাজারটা কারণও ব্যাখ্যা করে থাকেন।
তবে ইতিহাস বলে, সাম্প্রতিক অতীতেই ভারতে কিন্তু এমন প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন, যিনি বাংলাদেশে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক রাখার গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ঢাকায় যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, তখন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্রীয় সফরে দিল্লিতেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, যাতে দুপক্ষের মধ্যে সম্পর্কে একটা ‘নতুন সূচনা’ সম্ভব হতে পারে।
তিনি আর কেউ নন– ভারতের সদ্যপ্রয়াত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বরেণ্য অর্থনীতিবিদ ড. মনমোহন সিং। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) নিজে ভারতীয় দূতাবাসে গিয়ে যার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করে এলেন।
মনমোহন সিংয়ের ১০ বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বে (২০০৪-২০১৪) তিনি একাধিকবার খালেদা জিয়ার সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেছেন। এর মধ্যে ২০০৬ অবধি খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের অবকাশে দুই সরকারপ্রধানের দেখা হয়েছে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন ঢাকায় যান, তখনও তিনি দেখা করেছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে।
তবে মনমোহন সিং সরকারের খুব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল ২০১২ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশের বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়াকে ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রণ জানানো। মনে রাখতে হবে, তখন ঢাকার ক্ষমতায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার– যাদের সঙ্গে ভারতের দারুণ সুসম্পর্ক ছিল এবং ঢাকাও চাইতো না বিএনপির সঙ্গে দিল্লির আলাদা সম্পর্ক গড়ে উঠুক।
এছাড়া ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত খালেদা জিয়া সরকারের আমলে যেহেতু দু’দেশের সম্পর্ক নানা কারণে তলানিতে ঠেকেছিল, তাই ভারতেরও বিএনপি সম্পর্কে রীতিমতো ‘অ্যালার্জি’ ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন—খালেদা জিয়াকে দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিএনপির সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক ঝালিয়ে নিতে হবে।
এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মনমোহন সিং ক্যাবিনেটের সিনিয়র সদস্য সালমান খুরশিদেরও একটা বড় ভূমিকা ছিল। ঘটনাচক্রে খালেদা জিয়া ওই সফরে যেদিন দিল্লিতে পা রাখেন (২৮ অক্টোবর ২০১২), সেদিনই তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, খালেদা জিয়া সরকারকে (২০০১-০৬) নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার পরও মনমোহন সিং কেন তাকে ভারতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন?
দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষক (এখন প্রয়াত) জয়িতা ভট্টাচার্য সে সময় একটি প্রতিবেদনে লেখেন, ‘খালেদা জিয়াকে যে লাল কার্পেট বিছিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হচ্ছে, তার প্রধান কারণ হলো ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার “মোমেন্টাম”টা ধরে রাখতে চায়, বিশেষ করে নিরাপত্তা খাতে।’
‘২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাদের সহায়তায় ভারত উত্তর-পূর্বে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপে অনেকটা রাশ টানতে সক্ষম হয়েছে। সেসময় আলফা নেতা অরবিন্দ রাজখোয়া বা এনডিএফবি’র রঞ্জন দইমারিরা আটক হয়েছেন। বাংলাদেশে পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদল হলে এই সহযোগিতার ধারা ব্যাহত হতে পারে, ভারতের এই আশঙ্কাও আছে,’ আরও লিখেছিলেন জয়িতা ভট্টাচার্য।
তার যুক্তি ছিল, তখন পর্যন্ত বাংলাদেশে যেহেতু কোনও দল পরপর দুবার ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসেনি এবং সে সময় আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় ভাটার টান লক্ষ করা যাচ্ছিল–তাই বিএনপির ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনা আছে, এটা ধরে নিয়েই খালেদা জিয়াকে আগাম ভারত সফরে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রায় এক সপ্তাহব্যাপী সেই দিল্লি সফর ধারে ও ভারেও ছিল খুবই ওজনদার!
ওই সফরে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ, পার্লামেন্টে বিরোধীদলীয় নেত্রী বিজেপির সুষমা স্বরাজ, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব রঞ্জন মাথাই, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন— প্রত্যেকের সঙ্গেই বৈঠক করেছিলেন। খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিএনপির যে প্রতিনিধিদল দিল্লিতে এসেছিল, তাতেও ছিলেন আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, শমসের মোবিন চৌধুরী, সাবিউদ্দিন আহমেদের মতো হেভিওয়েটরা।
ওই সফরের সময়েই এক সাক্ষাৎকারে সাবিউদ্দিন আহমেদ জানান, বাংলাদেশ উপযুক্ত ‘ট্রানজিট ফি’ পেলে ভারতকে তাদের ট্রানজিট দিতেও কোনও অসুবিধা নেই– এটাই বিএনপির পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থান।
সফরে খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভারতীয় নেতৃত্বের আলোচনা হয়েছিল সন্ত্রাসবাদ দমন, অভিন্ন নদীগুলোর পানি ভাগাভাগি, সীমান্ত ম্যানেজমেন্ট ও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের মতো বিভিন্ন বিষয়ে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদানীন্তন মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিন বলেছিলেন, ‘খালেদা জিয়া কথা দিয়েছেন বিএনপি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের ভূখণ্ড কিছুতেই ভারতবিরোধী জঙ্গিদের ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না!’
বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের যে ট্র্যাক রেকর্ড, তারপরও ভারত কীভাবে খালেদা জিয়ার প্রতিশ্রুতিতে ভরসা রাখছে, এই প্রশ্নের জবাবে মি. আকবরউদ্দিন বলেন, ‘আমরা একটা নতুন সম্পর্কের সূচনা করতে চাই। আমরা দুপক্ষই একমত যে এখন আমাদের সামনের দিকে তাকানোর সময়, (গাড়ির) রিয়ার ভিউ মিররে তাকিয়ে (পেছনে কী ঘটেছে) দেখার কোনও প্রয়োজন নেই!’
খালেদা জিয়ার আমলে আগে কী ঘটেছে, সেসব ভুলে গিয়ে ভারত যে বিএনপির সঙ্গে একটা কার্যকর সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইছে– মুখপাত্রের কথা থেকে মনমোহন সিং সরকারের সেই সিদ্ধান্ত ছিল স্পষ্ট। সত্যি কথা বলতে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার কী ভাবছে, সেটাও কিন্তু আমলে নেওয়া হয়নি।
বস্তুত খালেদা জিয়ার সফরের পর ভারতের বিভিন্ন প্রথম সারির সম্পাদকীয় বা অপ-এড কলামেও আশা প্রকাশ করা হয়েছিল, বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক হয়তো এরপর আবার নতুন করে লেখা সম্ভব হবে।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ গৌতম সেন সফরের অব্যবহিত পর থিঙ্কট্যাঙ্ক আইডিএসএ-র জন্য একটি রিপোর্টে লেখেন, এই সফর হয়তো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের একটি দৃশ্যমান ‘ভারসাম্যমূলক অবস্থানে’র পথ প্রশস্ত করবে। ইঙ্গিত ছিল, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতের নীতি শুধু আওয়ামী লীগ-ঘেঁষা ও একেপেশে হবে না, বরং সে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে একটা ভারসাম্য রেখে চলবে।
বাস্তবে অবশ্য ওই সফরের কয়েক মাস পরেই দেখা গেলো, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি যখন রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার প্রথম বিদেশ সফরে ঢাকায় গেলেন– খালেদা জিয়া তার সঙ্গে দেখা করলেন না। কেন সেই বৈঠক সম্ভব হয়নি, তার জন্য বিএনপির তরফেও নানা যুক্তি ছিল। তবে বাস্তবতা হলো, ওই ঘটনার পরই দিল্লি ও বিএনপির সম্পর্ক আবার খুব খারাপ মোড় নেয়। এরপর ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের সঙ্গে দল হিসেবে বিএনপির সম্পর্ক একরকম স্তব্ধই হয়ে যায় বলা চলে।
কিন্তু সমকালীন ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে– যাবতীয় সন্দেহ ও অবিশ্বাস পাশে সরিয়ে রেখে ভারতের একজন প্রধানমন্ত্রী কিন্তু বাংলাদেশে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন, আর সেই লক্ষ্যে পদক্ষেপও নিয়েছিলেন! তা পরে নানা কারণে বাস্তবায়িত হয়নি, যদিও সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।