এল আর বাদল : জুলাই- অগাস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনে ছাত্র-জনতাকে নির্মমভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা, হত্যার ইন্ধন ও নির্দেশ প্রদানের অভিযোগে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৩৫০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি কয়েক লাখ। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরুল ইসলাম এসব তথ্য জানান। সূত্র :ভয়েস অব আমেরিকা
তিনি বলেন, এসব মামলায় এখন পর্যন্ত তৎকালীন সরকারি দলের নেতৃস্থানীয় হাই-প্রোফাইল ১০০ জনসহ ১০ হাজারের অধিক আসামি গ্রেফতার হয়েছে।
৫ আগস্টের পরে হওয়া অধিকাংশ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া তার সরকারের সাবেক মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের নেতা, পুলিশের সাবেক আইজি, ডিএমপির সাবেক কমিশনারসহ পুলিশের বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তা, সাংবাদিকসহ অনেককে আসামি করা হয়েছে।
অথচ এই আসামিদের মধ্যে অনেকে ঘটনার সময় দেশে ছিলেন না, কিংবা কারও কারও অবস্থান ছিল আন্দোলনের পক্ষে। আবার এসব আসামিদের কারও-কারও আন্দোলনের সময়কার ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে হত্যার মতো গুরুতর অভিযোগে আসামি করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতাকে ‘গণহত্যার’ অভিযোগে জনপ্রিয় লেখক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
গত ৫ আগস্ট ঢাকার আদাবরে গার্মেন্টসকর্মী রুবেল হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে ক্রিকেটার ও সাবেক সংসদ সদস্য সাকিব আল হাসানকে। যদিও সেই সময় এই ক্রিকেটার দেশে ছিলেন না।
আরেক গার্মেন্টসকর্মী হত্যাচেষ্টায় অভিযোগের মামলায় আসামি করা হয় আইনজীবী জেড আই খান পান্নাকে। অথচ ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে শক্ত ভূমিকা রাখেন। তাকেই আসামি করা নিয়ে চারদিকে সমালোচনা হলে পরবর্তী সময়ে মামলা থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হয়।
বেসরকারি সংস্থা মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) তথ্য অনুযায়ী, গত চার মাসে সারাদেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার সরকারের মন্ত্রী-এমপি এবং দলের নেতাকর্মীদের নামে গণহত্যা, হত্যা, গুম এবং অপহরণের অভিযোগে ৬৮০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৬৩ হাজার ৫৮৩ জনের নামে অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার ৪৮৭ জনকে।
এভাবে হাজার-হাজার মানুষকে আসামি করে মামলা করার কারণে ভুক্তভোগী পরিবারের ন্যায়বিচার প্রাপ্তিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
তারা বলছেন, একটি মামলায় নাম উল্লেখ করে আসামি করা হচ্ছে ২ থেকে ৩ শতাধিক মানুষকে। আবার অজ্ঞাতনামা কয়েকশ জনকে আসামি করা হয়েছে। বিপুল সংখ্যক আসামির কারণে তদন্তে অনেক সময়ক্ষেপণ হবে এবং বিচার প্রক্রিয়ায় দেখা দেবে দীর্ঘসূত্রতা। যার ফলে প্রকৃত আসামিরা পার পেয়ে যেতে পারে বলে ধারণা তাদের।
এভাবে ঢালাও মামলা সরকার দিচ্ছে না, কিন্তু তাতে সরকার 'বিব্রত' বলে উল্লেখ করেছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। গত ১২ নভেম্বর ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে আসিফ নজরুল বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে গায়েবি মামলা হতো। সরকারের পক্ষ থেকে গায়েবি মামলা দিত। আর এখন আমরা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো মামলা দিচ্ছি না।
সাধারণ লোকজন, ভুক্তভোগী লোকজন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তারা অন্যদের ব্যাপারে ঢালাও মামলা দিচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন আসিফ নজরুল।
এভাবে ‘ঢালাও মামলা’ বিব্রতকর উল্লেখ করে আইন উপদেষ্টা বলেন, “ঢালাও মামলার একটা খুব মারাত্মক প্রকোপ দেশে দেখা দিয়েছে। এটা আমাদের অত্যন্ত বিব্রত করে।
৫ ডিসেম্বর পুলিশ সদরদপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, ৫ অগাস্টের পরে অনেক 'মিথ্যা মামলা' হয়েছে। এসব মামলা নিয়ে 'বাণিজ্য' হচ্ছে। তাই মামলায় নাম থাকলেই পাইকারিভাবে গ্রেফতার করা যাবে না।
ওই সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পরে কেউ যদি ইচ্ছাকৃত বা উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা মামলা করে থাকেন, তাহলে আইন-বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা বাদীর বিরুদ্ধে নেয়া হবে। পেনাল কোডের ২১১ ধারা অনুযায়ী বিচারের মুখোমুখি হতে হবে সেই বাদীকে।
কেউ যদি মনে করেন দায়েরকৃত মামলাতে তার নিজের কোনো ইন্ধন বা সংশ্লিষ্টতা নেই, তাহলে তাকে সরাসরি পুলিশের কাছে আসার আহবান জানিয়ে আইজিপি বলেন, "আমরা বিনা যুক্তিতে বা তদন্ত ছাড়া পাইকারি হারে গ্রেপ্তার করব না। মামলা থাকলেই বা নাম থাকলেই গ্রেফতার করতে হবে, আইনেও তা নেই। যারা নিরীহ এবং মনে করছেন কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই, হয়রানি করার জন্য মামলায় নাম দেয়া হয়েছে, তারা এগিয়ে আসুন। আমরা আপনাদের বক্তব্য নিয়ে এগিয়ে যাব। চার্জশিট বা ফাইনাল রিপোর্ট দেব। সেখানে নিরীহরা বাদ যাবেন।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের কয়েকজন নেতা ভয়েস অব আমেরিকাকে জানিয়েছেন, তারা এখনও পর্যন্ত আদালতে যেতে পারছেন না। তবে আওয়ামী লীগ দেশে-বিদেশে আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কী বলছেন মানবাধিকার কর্মীর?
হত্যার ঘটনায় যেসব হত্যা মামলা হয়েছে, তাতে ঘটনাস্থল ও মামলার তারিখ ছাড়া এজাহারসহ সবকিছুই প্রায় অভিন্ন বলে মনে করছেন আইনজীবীরা। তারা বলছেন, মামলা হচ্ছে ঢাকায় আর আসামি হচ্ছে অন্য জেলার মানুষ। যার কারণে এসব মামলার গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হচ্ছে।
এ ছাড়া বেশির ভাগ আসামির ক্ষেত্রে ‘হুকুমদাতা-নির্দেশদাতা ও ইন্ধনকারী’ উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে এসব মামলা প্রমাণ করে বিচার নিশ্চিত করা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, গণহারে এমন মামলার কারণে পুরো তদন্ত প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হবে। এ ধরনের একটা মামলায় ১০০ জন আসামি আছেন। তখন প্রত্যেক আসামির আলাদা তদন্ত হবে। কারণ তদন্ত কর্মকর্তা চাইলে মতামত দিতে পারবেন না, ঘটনায় ওই ব্যক্তি ছিল না। তাকে তদন্ত করে এটা বলতে হবে। আবার দায়সারা তদন্ত করলে তখন সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না। এতে দেখা যাবে তদন্ত করতে ৫ বছর লাগছে। তখন অনেক আলামতও নষ্ট হয়ে যাবে।
মামলা এক জায়গায় আবার আসামি হয়েছে ভিন্ন জেলার। এতে বিচার কার্যক্রম দীর্ঘায়িত হওয়ার পাশাপাশি সত্যিকারের অভিযুক্ত ব্যক্তি বিচারের মুখোমুখি হওয়া থেকে পার পেয়ে যেতে পারে মনে করেন এই আইনজীবী।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “মামলা আগের মতো গণহারে হচ্ছে। মাঝখানে একটি মামলায় আমাকেও আসামি করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। মেরাদিয়া নামক একটি জায়গার হত্যাচেষ্টা মামলায় আসামি করা হয়েছিল। অথচ মেরাদিয়া কোথায় আমি জানিও না, যাওয়া তো দূরের কথা।”
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান এই আইনজীবী বলেন, “এখন যা হচ্ছে, সবই হত্যা মামলা। অনেক ভিকটিম আমার কাছে আইনি সহায়তার জন্য আসছে। দেখা যাচ্ছে, মামলা হয়েছে ঢাকায় আর আসামিদের মধ্যে ১০ জন বিনাইদহ, ১০ জন বরিশালের। এইভাবে বিভিন্ন জায়গার লোক নিয়ে একটি মামলায় ৩০০ জনকে আসামি করা হচ্ছে।
গণহারে আসামি করা এসব হত্যা মামলার তারিখ ও ঘটনার স্থল বাদ দিলে সবকিছুই একই। আসামিরাও প্রায় অভিন্ন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সাংবাদিক, সাহিত্যিক, আইনজীবী, খেলোয়াড় ও অভিনেতাদের ঢালাওভাবে হত্যা মামলার আসামি করা প্রসঙ্গে সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, এটা তো আপনি-আমি সবাই বুঝি। আমি নির্দিষ্ট কারও নাম না নিয়ে, নিজের নামই বললাম। এইভাবে গণহারে হত্যা মামলা ও আসামি করার কারণে মামলাগুলোর গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
তবে এসব মামলা আদৌ যে টিকবে না, তা আমি গ্যারান্টি দিতে পারি” বলে যোগ করেন পান্না। গণহারে আসামি করা প্রসঙ্গে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, আমাদের কাছে কিছু তথ্য এসেছে পুলিশ টাকা খেয়ে' কাউকে-কাউকে আসামি করছে। আবার কেউ ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে অন্যকে আসামি করছে।
আপনার মতামত লিখুন :