মহসিন কবির: শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর চরম সংকটে পড়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। ১৯৭৬ সালে রাজনৈতিক দলগুলো নিবন্ধনের সুযোগ পেলে তখন আবার আওয়ামী লীগ নামেই দলটি নিবন্ধিত হয়ে রাজনীতি শুরু করেছিলো।
ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে দুই কূলই হারিয়েছে আওয়ামী লীগ। রাজনীতিতে ফিরতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে রাজনীতিতে আবার ফেরার সব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ। এজন্য তারা বিভিন্ন উপায় খুঁজছে। সামাজিক মাধ্যমে তারা নিয়মিত নানা বক্তব্য দিচ্ছেন। সবাইকে এক করার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে অওয়ামী লীগ। ঢাকাসহ কয়েক জায়গায় বিভিন্ন সময় মিছিলও করেছে। তবে রাজনীতিতে ফিরে আসার তাদের সবচেয়ে বড় বাধা হত্যা মামলা। এ মামলা কিভাবে তারা মোকাবেলা করবে সেটাই দেখার বিষয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন ‘পতন ও সংকটের ধরন ভিন্ন’ হলেও এবারের সংকট দলটিকে পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্টের মতো ‘ছন্নছাড়া’ অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। অনেকে নেতা ভারতে কিংবা অন্য দেশে চলে গেছেন। এছাড়া অনেকে আটক হয়ে কারাগারে আছেন। এখনো প্রায় ৭০ জন নেতার কোন হদিস নেই। এমন একটি খবর প্রকাশ করেছে একটি জাতীয় দৈনিক।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, আওয়ামী লীগের কোনো অপরাধবোধ নেই। গণহত্যা আর অপরাধের বিষয়ে তাদের মধ্যে ন্যূনতম অনুশোচনাবোধও নেই। ক্ষমা চাওয়ার লক্ষণ নেই। উলটো পুলিশ হত্যার বিষয়টিকে সামনে এনে তারা গণহত্যার অপরাধের বাইরে আলাদা বয়ান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় দেশের মাটিতে গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের বিচার হতেই হবে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, ৫ থেকে ৮ আগস্ট দেশে কোনো সরকার ছিল না। এই সুযোগে খুনিরা পালিয়ে গেছে। আত্মগোপনে চলে গেছে। আমরা বলেছি, এই খুনিদের বিচার বাংলার মাটিতে হবে। শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। এ বিষয়ে সরকার ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছে। যাদের হাতে শহিদদের রক্ত, যারা মানুষকে নির্মমভাবে নির্যাতন ও খুন করেছে, তাদের বিচার হতেই হবে।
৫ অক্টোবর আবারও রাজনীতিতে ফিরে আসার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এ ঘোষণা দেয় দলটি। ফেসবুকে পেজে দেওয়া এক পোস্টারে আওয়ামী লীগ জানায়, বাংলাদেশের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক অনেক গভীর। দেশের অসমাপ্ত উন্নয়নের কাজ এগিয়ে নিতে স্বমহিমায় ফিরে আসবে তারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার ব্যর্থ হলেও নিজেদের কৃতকর্মের জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা না চাইলে মাঠের রাজনীতিতে ফেরা আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন হবে।
এদিকে ‘আওয়ামী লীগ ফিরে আসবে’ এমন মন্তব্য করার অভিযোগে ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আল মামুনকে তাৎক্ষণিক প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে এমন কোনো মন্তব্য করেননি বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
১১ডিসেম্বর দুপুরে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্যদের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় উপস্থিত ছিলেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেসুর রহমান, জেলা প্রশাসক মো. কামরুল হাসান তালুকদারসহ সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
সভায় বক্তব্য দেন ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি আনিসুর রহমান সজল। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘সম্প্রতি সদরপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন ইউএনও আল মামুন। অনুষ্ঠানে আমি বক্তব্য রাখি। সেখানে দিল্লি না ঢাকার প্রশ্নে বলা হয়েছিল, দিল্লির কোনো প্রেসক্রিপশনে বাংলাদেশ চলবে না। আনিসুর রহমান বলেন, ‘এরপর ওই ইউএনও আমাকে ডেকে নিয়ে কথা বলেন। ওই সময় তিনি তাঁর অঙ্গ ভঙ্গিতে এবং আমাদের ছলে কৌশলে বলার চেষ্টা করেন, আওয়ামী লীগ উইল বি কাম ব্যাক, টুডে অর টুমোরো (আওয়ামী লীগ ফিরে আসবে, আজ অথবা আগামীকাল)।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. রাশেদা রওনক খান গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘অপরাধ করলে তো দায় স্বীকার করতে হবে। দায় স্বীকার করে নেওয়ার মাঝেই আসলে একটি গণতান্ত্রিক চর্চার সূচনা ঘটবে। একেবারেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে গেছে, ফ্যাসিজমের একটা চর্চা হয়েছে। দায় স্বীকার করেই আসলে রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগকে খেলতে হবে, যা পরিস্থিতি আমরা দেখতে পাচ্ছি। এটা না হলে অনেক মহল থেকে কিন্তু দাবি উঠছে রাজনীতি করার পথ বন্ধ হয়ে যাবে আওয়ামী লীগের জন্য।’
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতা হত্যাকাণ্ডের দায়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিষয়ে নানা মহলে চলছে আলোচনা। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোর্তিময় বড়ুয়া গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘পুরো দলটাকে তাদের সমস্ত কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করতে পারার মতো আইনও কিন্তু আছে। তারা যেভাবে গণহত্যা চালিয়েছেন ২০২৪–এ, এগুলোতো মানুষ ভুলবে না এতো তাড়াতাড়ি। এ রকম একটি রাজনৈতিক দলকে যখন আপনি ব্যান করার জন্য উঠে পড়ে লাগবেন বস্তুত এটা তাদের পক্ষেই কাজ করবে। মানুষের সহানুভূতি অর্জন করতে তাদের সহযোগিতা করবে।’
তবে শেষ পর্যন্ত কী হয় তা দলটির অনুশোচনার ওপরেও নির্ভর করছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
আপনার মতামত লিখুন :