ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপর থেকে একে একে তার দলীয় নেতা, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসছে। যারা ক্ষমতাকে ব্যবহার করে হাজার কোটি টাকার অনিয়ম করেছেন। এবার আওয়ামী লীগ সরকার প্রধান শেখ হাসিনারই এক ভয়াবহ অনিয়মের গল্প সামনে এসেছে। যা হার মানিয়েছে রূপকথার গল্পকেও।
ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে নিজেকে নির্দোষ করে দুর্নীতির মামলা থেকে অব্যাহতি পান শেখ হাসিনা। জানা গেছে, ২০০১ সালে ক্ষমতা ছাড়ার দু’দিন আগে তড়িঘড়ি করে বিধি অমান্য করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার প্রকল্পের অনুমোদন দেন শেখ হাসিনা। ১২০ কোটি টাকা মূল্যের সেই প্রকল্প অনুমোদনের সময় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) পূর্ণাঙ্গ কোরাম ছিল না। ফলে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে সেই কমিটি অনুমোদন দেয়া ও প্রকল্পে পছন্দের ঠিকাদারকে দিয়ে অনিয়মের মাধ্যমে কাজ পাইয়ে দেয়ার অভিযোগে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো ২০০২ সালে মামলা করে।
সূত্র জানায়, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় থাকাকালে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও পরামর্শক নিয়োগের মাধ্যমে প্রায় ১২০ কোটি টাকা লোপাটের খবর পায় ওই সময়ের দুর্নীতি দমন ব্যুরো। এরপর ২০০১ সালে ক্ষমতা ছাড়ার ঠিক দুই দিন আগে ১৩ সদস্যের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুপস্থিতিতে মাত্র ছয় সদস্যের উপস্থিতিতে নিয়ম লঙ্ঘন করে এই প্রকল্পের বৈধতা দেয় একনেক। ২০০২ সালে শেখ হাসিনাসহ ছয় মন্ত্রী ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় পৃথক তিনটি মামলা করা হয়। অন্য আসামিরা ছিলেন সাবেক মন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া, এ এস এইচ কে সাদেক, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী ও মহীউদ্দীন খান আলমগীর। তাদের তিনজনই এখন মৃত।
মামলা চলাকালে পুরো তথ্য-প্রমাণসহ জমা দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করলে হাইকোর্টে রিট করেন শেখ হাসিনা। এরপর দীর্ঘদিন তা থমকে থাকার পর ২০১০ সালে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের হাইকোর্ট বেঞ্চ অভিযোগপত্র দাখিলের আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করে। আদালত বলেছিলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ মামলা করা হয়েছে। তা ছাড়া এতে মামলার গুণগত ভিত্তি নেই। তারপর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে মামলা থেকে সব আসামিকে অব্যাহতি দেয়। শেখ হাসিনাকে অব্যাহতি দেয়ার পেছনে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেন সে সময়ের দায়িত্ব পালন করা দুদকের এক কমিশনার ও একজন বিচারপতি।
দুদক মামলাটিতে শেখ হাসিনাসহ অন্য আসামিদের অব্যাহতি দিলেও সে সময়ের তদন্তকারী কর্মকর্তার তৈরি করা প্রতিবেদন মানবজমিনের হাতে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে শেখ হাসিনাসহ সব আসামির অপরাধের প্রমাণ মিলেছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার প্রকল্প বিষয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের কার্যনির্বাহী পরিষদের (একনেক) সিদ্ধান্তকে আমলে নিয়ে তিনটি মামলা করে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো। একনেকের সিদ্ধান্তগুলো ছিল-প্রকল্পের পরামর্শকের ব্যয় বৃদ্ধি, ভবন নির্মাণের ব্যয় বৃদ্ধি এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যয় বৃদ্ধি। তিনটি মামলায়ই শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করা হয়। মামলার পর থেকেই শেখ হাসিনা এবং অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন আইনি লড়াই করেছেন। ব্যুরো থেকে কমিশন হওয়ার পর ২০০৫ সালের ২৪শে আগস্ট বিচারপতি সুলতান হোসেন খানের কমিশন মামলাগুলোর অভিযোগপত্র দাখিলের নির্দেশ দেন। বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে শেখ হাসিনা আলাদা দু’টি রিট আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ ২০১০ সালের ৪ঠা মার্চ অভিযোগপত্র দাখিলের আদেশ অবৈধ ঘোষণা করেন।
অভিযোগ সম্পর্কে আদালত বলেন, অভিযোগগুলো ফৌজদারি আইনের কোনো বিধানের আওতায় পড়ে না। মামলা চললে বিবাদী আরও হয়রানির সম্মুখীন হবেন। আদালত পর্যবেক্ষণে এও বলেন, মামলার নথিপত্র উপস্থাপনের ক্ষেত্রে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে।
আদালতের ওই সিদ্ধান্তের পর দুদকের ওই তিন মামলায় অভিযোগপত্র দেয়া হয়নি। পড়েছিল দুদকের অনিষ্পন্ন শাখায়। এখানে পড়ে থাকা ব্যুরোর আমলের মামলাগুলো নিষ্পত্তির উদ্যোগের অংশ হিসেবে তিনটি মামলা পুনঃতদন্তের জন্য উপ-পরিচালক মঞ্জুর মোরশেদকে দুদকের পক্ষ থেকে দায়িত্ব দেয়া হয়। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনটি মামলারই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের সুপারিশ করেন তদন্ত কর্মকর্তা। অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়ার সুপারিশ করেন শেখ হাসিনাসহ এজাহারভুক্ত সব আসামিকে। যাচাই বাছাই শেষে ২২শে জানুয়ারি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন।
দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মঈদুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যেসব মামলা ছিল, সেই মামলাগুলো আদালত মানে হাইকোর্ট খারিজ করে দিয়েছিলেন। এভাবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সব মামলার নিষ্পত্তি হয়েছিল।
এদিকে দুর্নীতি দমন ব্যুরোর আমলে দায়ের করা মামলাগুলোর তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, একনেকের সভায় নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার নির্মাণ প্রকল্পে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ দেয়ার কথা থাকলেও তা মানা হয়নি। নিয়ম ভঙ্গ করে শেখ হাসিনা তার পছন্দের ঠিকাদার দিয়ে কার্যাদেশ দেয়ার কৌশল অবলম্বন করেন। এতে সরকারের ৪ কোটি টাকারও বেশি অর্থ ক্ষতিসাধন হয়েছে বলে প্রমাণ হয়।
এ ছাড়া যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ অর্থ ক্ষতি হয়েছে বলে দুর্নীতি দমন ব্যুরোর তদন্তে প্রমাণ হয়। এসব বিষয় আমলে নিয়ে ব্যুরো সব রকম প্রমাণাদি ও আলামত সংগ্রহ করে ব্যুরোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অভিযোগপত্র দাখিলের সুপারিশ করেন। কিন্তু পরে আর তা সম্ভব হয়নি। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ফের ক্ষমতায় এসে নিজ ও দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা থেকে কৌশলে অব্যাহতি নেন। উৎস: মানবজমিন।
আপনার মতামত লিখুন :