সময়ের আলোর প্রতিবেদন : বর্তমানে মাঠে দুই বড় দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী নিজেদের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। দুই দলের শীর্ষনেতাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে। এক দল আরেক দলকে নিজেদের অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিচ্ছেন। সামনে নির্বাচন ও বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় দুই দলই কাছাকাছি থাকতে চায়।
বিএনপি ও জামায়াতের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, এই সময়ে নিজেদের মধ্যে বৈরিতা মানে সবার জন্য অমঙ্গল। এই ফাঁকে অন্য কেউ ফায়দা লুটবে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবিলার জন্য বিএনপি-জামায়াতকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আগের মতো মাঠে সক্রিয় থাকতে হবে দুই দলকে।
নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্যগুলো আলোচনার টেবিলে বসে ঘুচিয়ে আনতে হবে। নির্বাচনি জোট কিংবা সমঝোতা প্রশ্নেও আলোচনার মধ্যে সমাধান খুঁজছে শক্তিশালী এই দুই দল। তারা বলেন, বিশেষ করে নির্বাচন ইস্যু এবং জাতীয় ঐকমত্যের প্রশ্নে যাতে কোনো মনোমালিন্য কিংবা দূরত্ব তৈরি না হয়, সেদিকে আমাদের মনোযোগ দেওয়া দরকার। এ জন্য জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখার তাগিদ দেন নেতারা।
সম্প্রতি হঠাৎ করে লন্ডন সফরে গেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। দলের আমিরের হঠাৎ লন্ডন সফর কী কারণে এ নিয়ে জামায়াতের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য কিংবা বিবৃতি পাওয়া যায়নি। গত মঙ্গলবার পূর্ব লন্ডনের মায়েদা গ্রিল হলে অনুষ্ঠিত বৃটেনের সর্বদলীয় উলামা সংগঠন ‘বাংলাদেশি উলামা মাশায়েখ ইউকে’ আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় অংশ নেন তিনি।
সেখানে জামায়াতের আমির বলেন, আমরা ঐক্য চাই। আবার বিভিন্ন শর্ত দিয়ে বসে থাকি। একজন শর্ত দিলে তো অন্যজনও শর্ত দেবেন। এভাবে শর্তের বেড়াজালে শেষ পর্যন্ত ঐক্য প্রক্রিয়া কঠিন হয়ে যায়। কিছু বেসিক জায়গা ঠিক থাকলে আমাদের মধ্যে ঐক্য হওয়া সম্ভব।
জামায়াতের একাধিক সূত্র বলছে, সাংগঠনিক কার্যক্রমকে গতিশীল করতে আমিরের লন্ডন সফর। ইতিমধ্যে কয়েকটি কর্মসূচিতে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। সফরের এক ফাঁকে লন্ডনে থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হতে পারে বলে খবর চাউর হচ্ছে।
এ বিষয়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম সময়ের আলোকে বলেন, মূলত সাংগঠনিক কাজে আমিরে জামায়াত লন্ডনে গেছেন। দলের দায়িত্বশীল কেউ সঙ্গে যাননি। লন্ডনের নেতাকর্মী-শুভাকাক্সক্ষীদের সঙ্গে মতবিনিময় হবে। ইতিমধ্যে একটি হয়েছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষতের সম্ভাবনা আছে কি না? জবাবে তিনি বলেন, এটা ঠিক আমি বলতে পারব না। সিলেটের মানুষ হিসেবে লন্ডনে আমিরে জামায়াতের অনেক আত্মীয়স্বজন আছেন, সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে দেশে ফিরবেন। দেশে ফেরার তারিখ ঠিক হয়নি।
বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্কের আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে জানিয়ে জামায়াতের এই নেতা বলেন, আমরা বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছে। একে অন্যকে তাদের অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিচ্ছেন। বৃহস্পতিবার গুলশানে বিএনপির রাষ্ট্র সংস্কারের সেমিনারে আমরা অংশগ্রহণ করব। সম্পর্ক সামনে আরও ভালো হবে বলে আশা করি।
তিনি বলেন, আমরা কিন্তু বলিনি বিএনপির সঙ্গে আমাদের জোট নেই। এটা বিএনপিই প্রথম বলেছে তারা ২০ দলীয় জোট ভেঙে দিয়েছে।
২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশের আগের দিন এক অনানুষ্ঠানিক সভায় শরিকদের ডেকে তৎকালীন ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেয় দলটি। জোট ভেঙে দেওয়ার পরও জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির যোগাযোগ ছিল। ১০ দফা দাবিতে ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর থেকে বিএনপির নেতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলন শুরু হয়। শুরুতে জামায়াত দুটি কর্মসূচি যুগপৎভাবে পালন করলেও পরে দলটি নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে আওয়ামী সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে সক্রিয় ছিল।
ঢাকা উত্তর জামায়াতের একজন নেতা বলেন, বিএনপির মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছেন জামায়াতের দায়িত্বশীল নেতারা। বিএনপি আপন ভাইয়ের মতো আচরণ করে নাকি সৎ ভাইয়ের মতো আচরণ করে-এগুলো এখন দেখার বিষয়। কারণ গত আন্দোলনে বিএনপির ভূমিকা ছিল মধ্যপন্থার মতো। তারা জামায়াতের নেতাকর্মীদের পাশে সরাসরি থাকেনি। কোনো বিবৃতি কিংবা প্রতিবাদ পর্যন্ত জানায়নি। তাদের এমন নীরব ভূমিকায় জামায়াতের মাঠের নেতাকর্মীরা অনেকটা ক্ষুব্ধ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দুই দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হলে হয়তো দূরত্ব কমে যাবে। যা দুই দলের জন্যই লাভ।
লন্ডনে কি বিএনপির শীর্ষ নেতার সঙ্গে আমিরের বৈঠক হতে পারে? জবাবে তিনি বলেন, হতেও পারে। কারণ এখনকার পরিবেশ তো ভিন্ন। শীর্ষ দুই নেতার আলাপচারিতায় তো বাধা নেই। তবে এটার কোনো নির্ধারিত শিডিউল নেই।
অন্যদিকে গত সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হয়।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সময়ের আলোকে বলেন, দূরত্ব বলতে কিছু নেই। এটি কৌশলগত বিষয়। গণতন্ত্রের প্রশ্নে আমাদের সবার ঐকমত্য আছে। মতপার্থক্য কিছু থাকতে পারে, এটা স্বাভাবিক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, জামায়াত নিয়ে এখন কমেন্ট করাটা ঠিক হবে না। এখানে দেশি-বিদেশি নানা বিষয় জড়িত। জামায়াতের বিষয়টি হাইকমান্ড সরাসরি দেখছেন। আমরা প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে গেলে দলের ও দলের বাইরে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান সময়ের আলোকে বলেন, জামায়াত নিয়ে এখনই মন্তব্য করা যাবে না। আরও পরে এই সম্পর্কে কথা বলা যাবে।
এ প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার সময়ের আলোকে বলেন, মতপার্থক্য তো থাকবেই। মতপার্থক্য না থাকলে দেশে একটি দল থাকত। রাজনীতিতে অনেক কথাই হয়, হবে। পার্থক্য যতটা কমিয়ে আনা যায় সেই চেষ্টা থাকবে। বিএনপির সঙ্গে আমাদের সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :