গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের প্রেক্ষাপটে প্রায় সাড়ে ১৫ বছর পর স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রমে ফিরেছে ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতে ইসলামী। এই মুহূর্তে সারা দেশে দলটি ঘরোয়া কার্যক্রমে ব্যস্ত। তবে দীর্ঘদিনের ফেরারি অবস্থান থেকে হঠাৎ রাজনীতির সম্মুখভাগে আসা জামায়াত তার প্রায় ২৫ বছরের জোটসঙ্গী বিএনপিকে ‘মাইনাস’ করেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দলটি ইতিমধ্যে দেড়শর বেশি আসনে প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছে। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে এসব প্রার্থীকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন আলোচনায় সংস্কারকে প্রাধান্য দিলেও তলে তলে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি।
আগামী নির্বাচনে দুই ধরনের প্রস্তুতি রেখে এগোচ্ছে জামায়াত। সেটি হচ্ছে ৩০০ আসনে একক প্রার্থী দেওয়া এবং নির্বাচনের সময় বিরাজমান পরিস্থিতির আলোকে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া। এই লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই একাধিক ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে দলটি। তাদের লক্ষ্য- ধর্মভিত্তিক এসব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে বেশি আসনে জয়ী হয়ে আসা।
বিষয়টি অবশ্য নেতিবাচকভাবে দেখছে না বিএনপি। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, দুই দলের রাজনৈতিক আদর্শ ভিন্ন। তাই তারা তাদের মতো রাজনীতি করবে, বিএনপি তাদের মতো।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনের ব্যাপারে জামায়াতের দুই ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। প্রথমত, জামায়াত নিজেরাই ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের সময় যখন আসবে, তখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করবে, সেই পরিস্থিতির আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সেটি এককভাবে, নাকি জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া হবে, তা এখনই বলার সুযোগ নেই।’
তিনি জানান, ‘নির্বাচনের কার্যক্রম জামায়াত অনেক আগেই শুরু করেছে। তাদের দেড়শর বেশি প্রার্থী আগে থেকেই ঠিক করা আছে। এখন জামায়াতের প্রার্থীরা মতবিনিময়, গণসংযোগ করার মধ্য দিয়ে সারাদেশে তাদের তৎপরতা চালাচ্ছে। বাকি আসনে প্রার্থীদের বিষয়ে জামায়াতের যে নিয়ম (পার্লামেন্টারি বোর্ড, স্থানীয় পর্যায়ের মতামত ও কেন্দ্রীয়ভাবে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত) বাছাইয়ের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনী জোট করার লক্ষ্যে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জামায়াত ১৫ আগস্ট থেকে কাজ শুরু করেছে। এর মধ্যে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন, ১২-দলীয় জোট, জাকের পার্টি, লেবার পার্টি, খেলাফত মজলিস ও ফরায়েজী আন্দোলনের সঙ্গে তারা বৈঠক করেছে। এ ছাড়া খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সিনিয়র নায়েবে আমির আব্দুল মাজেদ আতাহারী, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের (একাংশ) আমির আবু জাফর কাসেমী, জামিয়া মাদানিয়ার মুহতামিম মনিরুজ্জামান কাসেমী, জনসেবা আন্দোলনের আমির ফখরুল ইসলামসহ ব্যক্তিপর্যায়ে বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক ও আলেমদের সঙ্গে জামায়াতের আমির পৃথক মতবিনিময় করেছেন।
মতিউর রহমান আকন্দ জানান, ‘জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য তারা তৎপরতা চালাচ্ছেন। ইসলামী দল, ১২-দলীয় জোট, গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটসহ কয়েকটি ইসলামী দল ও শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তাদের ইতিমধ্যেই মতবিনিময় হয়েছে। তবে নির্বাচনী জোট গঠনের কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি।’
জামায়াতের সঙ্গে মতবিনিময়ে অংশ নেওয়া একাধিক দলের নেতা দেশ রূপান্তরকে জানান, ইসলামপন্থি দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনী ঐক্য চায় জামায়াত। তবে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনী ঐক্য হবে কি না, অনেকটাই নির্ভর করছে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনের ওপর। এই দলটির কারণে অনেক দলই জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোটে অংশ নিতে পারে। নির্বাচনী ঐক্য হলে ভালো, না হলেও জামায়াত তাতে খুব সমস্যা মনে করছে না।
কারণ দলটি এবার এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সারা দেশেই নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে সরব রয়েছে। এসব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে যেসব নির্বাচনী আসনে ভালো করতে পারবে, সেসব আসনে প্রার্থীদের নামও ঘোষণা করা হচ্ছে। নির্বাচন সামনে রেখে এ-সংক্রান্ত কমিটিগুলোর নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে। বৈঠক থেকে জেলাগুলোর দায়িত্বে থাকা নেতাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। যেসব আসনে প্রার্থী এখনো বাছাই হয়নি, সেখানে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়ায় নতুন প্রার্থী যোগ-বিয়োগ করছে এই কমিটি।
সম্প্রতি কক্সবাজারের চকরিয়ায় এক সমাবেশে কক্সবাজার শহর জামায়াতের আমির আবদুল্লাহ আল ফারুককে চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেন সংগঠনটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা মুহাম্মদ শাহজাহান। জামায়াতের ঢাকা মহানগর উত্তরের নবনির্বাচিত আমির মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন আগামী নির্বাচনে সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ) আসনে জামায়াতের পক্ষ থেকে নিজের প্রার্থিতা ঘোষণা করা হয়।
বিএনপি বলছে, আগামী সংসদ নির্বাচনে জামায়াত এককভাবে প্রার্থী দেবে, নাকি জোটগতভাবে দেবে, সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। জোটসঙ্গী হলেও জামায়াতের রাজনীতি নিয়ে বিএনপি কখনো আগ বাড়িয়ে কিছু বলেনি। বরং জামায়াত সহায়তা চেয়েছে, বিএনপি সেটা করার চেষ্টা করেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা নিজেদের মতো এগোলেও বিএনপির তাতে হস্তক্ষেপ করবে না।
জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির নির্বাচনী জোট ছিল। আদর্শিক কোনো বিষয় ছিল না। তারা একসময় বিএনপির সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় ছিল। আরেক সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। তাদের দুই রূপই আমরা দেখেছি। এখন জামায়াতের রূপ যদি ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মতো হয়, তাহলে তাদের সঙ্গে আমাদের নির্বাচনী জোট হতে পারে। সেটা না থাকলে একসঙ্গে আর নির্বাচন করা হবে না। তারা তাদের মতো চলবে। আমরা আমাদের মতো রাজনীতি করব।’ উৎস: দেশ রুপান্তর।
আপনার মতামত লিখুন :