শিরোনাম

প্রকাশিত : ২৪ অক্টোবর, ২০২৪, ১২:২৭ রাত
আপডেট : ২৪ অক্টোবর, ২০২৪, ০২:২৩ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ছাত্রলীগ যেভাবে প্রতিষ্ঠিত ও বিতর্কিত হয়ে উঠেছিল

১৯৪৮ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার এক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ছাত্রলীগের। তখন অবশ্য এই সংগঠনের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। এর এক বছর পরে জন্ম হয় আওয়ামী লীগের। ভাষা আন্দোলন, স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেও বড় ভূমিকা রেখেছিল ছাত্রলীগ।

তবে অনেকের মতে স্বাধীনতার পরে নানাভাবে বিতর্কিত হয়ে উঠেছে ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটি। সর্বশেষ চলতি বছরে জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমাতে শেখ হাসিনার সরকারের নির্দেশে ছাত্রলীগ ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। এভাবে গণহত্যার দায়ে সংগঠনটি আরো বির্তকিত হয়ে ওঠে। এসব নানা বির্তকের কারণে বুধবার (২৩ অক্টোবর) রাতে এই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

বিবিসি বাংলা গত বছরের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে ছাত্রলীগর বিতর্কিত হওয়ার নানা কারণ তুলে ধরা হয়। 
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জন্ম সম্পর্কে ড. মোহাম্মদ হান্নান তাঁর ‘বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ভারত ভাগ হওয়ার আগে এই অঞ্চলে ছাত্র ফেডারেশনের মাধ্যমে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল ছাত্ররা। কিন্তু তারা ছিল গোঁড়া থেকেই ‘অসাম্প্রদায়িক ও বিপ্লবী উদ্দীপনায় ভরা ছাত্রদের সংগঠন।

তাদের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল, কারণ অবিভক্ত বাংলাদেশ থাকতেই এই সংগঠন কমিউনিস্টদের দ্বারা পরিচালিত বলে চিহ্নিত হয়ে পড়েছিল।’
তিনি লিখেছেন, দেশ বিভক্ত হয়ে যে ছাত্র-সংগঠনটি সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়, তা হচ্ছে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। কারণ যে লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য কর্মসূচিকে ভিত্তি করে এরা ছাত্র রাজনীতি করে এসেছে, তারই ফসল হচ্ছে পাকিস্তান।

ছাত্র ফেডারেশনের মতো নিখিল পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম ছাত্রলীগের নতুন কোনো কমিটি হলো না। বরং ৪৭-পূর্ব কলকাতা কেন্দ্রিক নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের জাতীয় কমিটি ঢাকায় তার কার্যালয়টুকু মাত্র স্থানান্তর করল।

শুধুমাত্র নিখিল বঙ্গ স্থানে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান বসলো।
ড. মোহাম্মদ হান্নান তার বইতে আরো লিখেছেন, ‘কিন্তু ১৯৪৭-এর পরে এই সংগঠনের নেতৃত্বে চরম কোন্দলের সৃষ্টি হয়। ইতোমধ্যে পাকিস্তানে ভাষা প্রশ্নের বিতর্কও শুরু হয়ে যায়। ভাষা প্রশ্নে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এক ন্যক্কারজনক ভূমিকা পালন করতে থাকলে সংগঠনের বিদ্রোহী অংশ শুধুমাত্র ‘নিখিল শব্দটি বাদ দিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ নামে একটি ভিন্ন আহবায়ক কমিটি গঠন করে।’

‘১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি এই বিদ্রোহী ছাত্রলীগের অস্থায়ী সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল মিলনায়তনে নাজমুল করিমের সভাপতিত্বে বিদ্রোহী ছাত্রলীগ কর্মীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রনেতা অলি আহাদ সম্মেলনে নেতৃত্ব দেন। সম্মেলনে নইমুদ্দিন আহমদ (রাজশাহী) কেন্দ্রীয় কমিটির আহবায়ক এবং অলি আহাদ ঢাকা শহর শাখার ছাত্রলীগের আহবায়ক নির্বাচিত হন। তবে পুনর্গঠিত এই নয়া আন্দোলন ছাত্রলীগ গঠনে মূল উদ্যোগ গ্রহণ করেন ছাত্ররাজনীতি থেকে প্রায় বিদায় গ্রহণকারী ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান।’

যেভাবে বিতর্কিত হয়ে ওঠে ছাত্রলীগ :  লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ‘১৯৭১ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগ ছিল একটি সরকার বিরোধী ছাত্র সংগঠন। আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন হলেও ছাত্রলীগের মধ্যে এক ধরনের স্বাতন্ত্র্য কাজ করছিল। তাদের মধ্যে স্বকীয়তা, স্বাধীনতা ছিল। প্রায় প্রতিবছর কাউন্সিল হতো, নেতৃত্বের পরিবর্তন হতো। কিন্তু একাত্তর পরবর্তী সময়ে আমরা দেখলাম, আওয়ামী লীগ সরকারে গেলে, আর সরকারি দলের অঙ্গ সংগঠন হলে যা হয়, যেটা আমরা পাকিস্তান আমলে এনএসএফের (তখনকার সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন) মধ্যেও দেখেছি, সেই চরিত্র আস্তে আস্তে ছাত্রলীগের মধ্যে প্রবিষ্ট হতে থাকল। ধীরে ধীরে একটা লড়াকু ছাত্র সংগঠন আস্তে আস্তে তার চরিত্র বদলে একটা ক্ষমতাসীন দলের লাঠিয়াল সংগঠনের দিকে যাত্রা শুরু করল।’ 

তিনি বলছেন, ‘সেই সময় সংগঠনের মধ্যেই পক্ষে-বিপক্ষে নানারকম বিভক্তির শুরু হয়। এক দল মনে করল সরকারের পক্ষে থাকবে, আরেক দল মনে করল তারা স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখবে। এভাবে ছাত্রলীগের বিভক্তি ১৯৭২ সালে শুরু হয়। এরপর আওয়ামী লীগ ভাগ হয়েছে, ছাত্রলীগও ভাগ হয়েছে। 

গত কয়েক বছরে দেশের নানা এলাকায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণের মতো ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।

দুর্নীতি ও চাঁদাবাজিসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ ওঠার পর ২০১৯ সালে ছাত্রলীগের তৎকালীন কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। এরপরেও বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, অর্থের বিনিময়ে কমিটি গঠনের মতো অভিযোগ ওঠে।

যেমন ২০১৯ সালে সিলেটের এমসি কলেজে তরুণীতে ধর্ষণের অভিযোগে ছয় ছাত্রলীগ কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সেই বছর বুয়েটের আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে বিচার চলছে বুয়েট ছাত্রলীগের ১৯ নেতাকর্মীর।

২০১২ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশ্যে বিশ্বজিৎ দাসকে কুপিয়ে হত্যার অভিযোগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ২১ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। তাদের আটজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটাবিরোধী আন্দোলনের মতো একাধিক ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও মারধর করার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ‘ছাত্রলীগের যে ঐতিহ্য আমরা ৫০/৬০-এর দশকে দেখেছি, সেটা নানা দমন-নিপীড়নের দায়ে এখন পুরোপুরি অনুপস্থিত। তাদের এই ভূমিকার কারণে ছাত্র রাজনীতি পুরোপুরি তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে। উৎস: কালের কণ্ঠ।

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়