দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটের মাঠে ছিলেন বিএনপির সাবেক হেভিওয়েট অন্তত সাত নেতা। বিএনপি নির্বাচনে না থাকার সুযোগ কাজে লাগাতে নতুন দল ও জোট গঠন করেছিলেন ভোটের মাঠে। এমপি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তারা। দুজন এমপিও হয়েছিলেন। কিন্তু সংসদ নির্বাচনের সাত মাস পরই ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর দাপুটে ওই সাত নেতা পড়েছেন মহাসংকটে। দীর্ঘদিনের রাজনীতির ক্যারিয়ারও ধ্বংসের মুখে।
একদিকে বিএনপিতে ফেরার পথ কঠিন, আবার জনগণের দৃষ্টিতে ‘জাতীয় বেইমান’ ও ‘সরকারের দোসর’ তকমাও পেয়েছেন। বিএনপির কয়েক যুগের পরীক্ষিত সাবেক নেতারা এখন দুই কূল হারিয়ে দিশেহারা।
বিএনপির একাধিক নেতা বলছেন, শাহজাহান ওমর, সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, শমসের মবিন চৌধুরী, তৈমূর আলম খন্দকারসহ সাতজনেরই স্বপ্ন ছিল এমপি হওয়া। বিএনপির সব মহলেও তাদের আলাদা গ্রহণযোগ্যতা ছিল। হঠাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের প্রলোভনে পড়ে ভোটে গিয়ে ভুল রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন। তারা ভোটারদের কথাও ভাবেননি। দীর্ঘ ১৫ বছর ধৈর্য ধরলেন, আর কিছুদিন দিন অপেক্ষা করতে পারতেন না? অবশ্য তারা এও বলছেন, তাদের রাজনীতি এখন মৃত্যুর মুখে। এখন তো তাদের ‘সাত মাসের এমপি’ও তকমা দিচ্ছে ছাত্র-জনতা। বিএনপিতে তাদের ফেরার সুযোগ নেই বললেই চলে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘তারা এখন ভালো অবস্থানে নেই। কেউ কেউ তো দল বদল করেছেন, আবার কেউ কেউ নতুন দল গঠন করেছেন। তাদের রাজনীতির ভবিষ্যৎ এখন অন্ধকারের দিকে ধাবিত হতে পারে। তারা হয়তো দুই কূল হারাতে বসেছেন, তবে সময়ই সবকিছু বলে দেবে।’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘হাইকমান্ডের পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বিএনপিতে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী বা অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের যোগদানের সুযোগ নেই। বহিষ্কৃতদের দলে ফেরানোর ব্যাপারে এ মুহূর্তে কোনো আলোচনা নেই।’
দীর্ঘ ৪৫ বছরের বিএনপির রাজনীতির ইতি টেনে গত বছরের ৩০ নভেম্বর আওয়ামী লীগে যোগ দেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর (বীর উত্তম)। ওই দিনই তাকে বহিষ্কার করে বিএনপি। নৌকা প্রতীকে ঝালকাঠি-১ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। শাহজাহান ওমর খবরে কাগজকে বলেন, ‘আমি আর দল ত্যাগ করব না। বুঝেশুনে আওয়ামী লীগেই যোগ দিয়েছি, রাজনীতি করলে এখানেই থাকব। এখন বয়স হয়ে গেছে, যদি ভালো লাগে রাজনীতি করব, না হয় অবসরে যাব। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জিয়াউর রহমানের ডাকে মুক্তিযুদ্ধ করেছি।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা হয়। তবে বিএনপিতে আর ফিরব না।’
গত বছরের ২২ নভেম্বর চারদলীয় ‘যুক্তফ্রন্ট’ জোট গঠন করে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম (বীর প্রতীক)। বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘ ১৬ বছরের সর্ম্পক ছিন্ন করেন। কক্সবাজার-১ আসন থেকে হাতঘড়ি মার্কায় বিপুল ভোটে জয়লাভ করে এমপি হয়েছিলেন। তবে ভোটে অংশ নেওয়ায় সেই সময়ে বিএনপি ও ১২-দলীয় জোট নেতাদের সমালোচনার মুখে পড়েন বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ।
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, ‘দীর্ঘ ১৬ বছরের সম্পর্কের তুলনায় সাত মাস কিছুই নয়। বিএনপির কারও কারও সঙ্গে যোগাযোগ আছে। তবে বিএনপি জোটে ফিরব কি না তা এখনই বলা যাচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে আমরা প্রস্তুত। বিএনপি নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দিতে চায়। এই প্রস্তাবের সঙ্গে আমরাও একমত।’
তবে ১২-দলীয় জোটে সৈয়দ ইবরাহিমের ফেরার আর সুযোগ নেই বলে সাফ জানিয়েছেন জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপি মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম। তিনি বলেন, ‘জোট থেকে বেরিয়ে গিয়ে যারা প্রহসনের ডামি নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, তাদের ফেরার প্রশ্নই আসে না। জাতির সঙ্গে বেইমানি করার অভিযোগে এদের আইনের আওতায় আনতে হবে। বিএনপির সমমনা জোটে বেইমানদের কেউ অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করলেও প্রতিহত করা হবে।’
দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ২০২০ সালে দল থেকে বহিষ্কৃত হন কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক এমপি মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান রঞ্জন। ৩২ বছরের বেশি রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়। বহিষ্কারের পরও তাকে বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচিতে দেখা যেত। তবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-২ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে জামানত হারিয়েছেন। আখতারুজ্জামান বলেন, ‘রাজনীতিতে আমার যা কিছু লক্ষ্য ছিল সবই অর্জন করেছি। বিএনপির রাজনৈতিক বন্ধু ও সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। তবে বিএনপিতে ফেরা নিয়ে তাদের সঙ্গে কোনো কথা হয় না। আমার বয়স হয়ে গেছে, এখন রাজনীতির মাঠে সেভাবে দৌড়াতে পারছি না। তাই আগামীতে আর নির্বাচনে দাঁড়াব না।’
তিনি বলেন, ‘এবারের সরকার পতনের অভ্যুত্থান করেছে ছাত্ররা। ’৬২ ও ’৬৯ আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি। ২০২৪ সালের ছাত্ররা আরেকটি বিপ্লব ঘটিয়েছে। তাই আন্দোলনের পর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নতুন প্রজন্মের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। তাই রাজনীতিবিদদের কাজ হবে নতুন প্রজন্মকে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা। দেশকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে এখন নতুন প্রজন্মকে তৈরির চিন্তা-ভাবনা করছি। অতীত ভুলের সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হবে।’
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান নাজমুল হুদার প্রতিষ্ঠিত তৃণমূল বিএনপিতে ২০২৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর যোগ দেন বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। শমসের মবিন তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান ও তৈমূর আলম মহাসচিব নির্বাচিত হন। শমসের মবিন চৌধুরী বিএনপিতে যোগ দেন ২০০৭ সালে। বিএনপি জোট সরকার আমলে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা শমসের মবিন বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন ২০১৫ সালের ২৮ অক্টোবর। ৩ বছর পর যোগ দেন বিকল্পধারা বাংলাদেশে। গত সংসদ নির্বাচনে সিলেট-৬ আসন থেকে তৃণমূল বিএনপির শমসের মবিন চৌধুরী অংশ নিয়ে জামানত হারিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি তৃণমূল বিএনপিতে থাকছি। বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি, বিভিন্ন টেলিভিশন ও সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে সময় পার করছি। বর্তমানে রাজনীতির পরিবেশও নেই। তবে বিএনপির কারও সঙ্গে সেভাবে যোগাযোগ নেই।’
শমসের মবিন বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত জনগণ। ভোটের সময় বিএনপি বা অন্য কারও সঙ্গে জোট করা যায় কি না ভেবে দেখব।’
অন্যদিকে তৈমূর আলম খন্দকার বিএনপিতে যোগ দেন ১৯৯৬ সালে। তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ও মহানগরের নেতৃত্বে ছিলেন। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে (নসিক) বিএনপির প্রার্থীও ছিলেন। তবে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হলে তখন বহিষ্কৃত হন তৈমূর আলম। পরে পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দেন।
তৈমূর আলম বলেন, ‘বিএনপির হাইকমান্ড আমাকে কখনো আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও দেয়নি। যদি কখনো ডাকে তাহলে সিটি নির্বাচনে দাঁড়াতে কারা উৎসাহিত করেছিলেন তাদের বিষয়ে বলব। যেহেতু সুযোগ পাইনি, তাই এসব নিয়ে কিছু আর কিছু বলতে চাই না। তবে বিএনপিতে ফিরব কি না, সময় বলে দেবে।’
বিএনপি থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) নতুন দল গঠন করে সংসদ নির্বাচন অংশ নেন সাবেক দুই এমপি শাহ আবু জাফর এবং আব্দুর রহমান। আবু জাফর জাতীয় পার্টি থেকে বিএনপিতে যোগদান করেন ২০০৩ সালে এবং আব্দুর রহমান ১৯৯৬ সালে। ২০২৩ সালের ২০ নভেম্বর বিএনপি ছেড়ে দুজনই বিএনএমে যোগ দেন। তবে সংসদ নির্বাচনে প্রত্যেকেই জামানত হারিয়েছেন।
বিএনএম চেয়ারম্যান শাহ আবু জাফর বলেন, ‘সরকার পতনের পর বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে কেউ যোগাযোগ করেননি। তবে নিচের সারির অনেকেই যোগাযোগ করেছেন। বিএনএমকে গুছিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। আগামী নির্বাচন যদি জোটবদ্ধ হয়, তাতে আমাদের কোনো অসুবিধা নেই।’
বিএনএমের মহাসচিব আব্দুর রহমান বলেন, ‘এখানেই আছি, কোথাও যাওয়ার ইচ্ছাও নেই।’ সূত্র : খবরের কাগজ, বাংলাভিশন
আপনার মতামত লিখুন :