টাইমস ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন : কোটা সংস্কার আন্দোলনে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন কঠিন পরিস্থিতিতে ছিলেন, তখন পারিবারিক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে একটি বার্তা পাঠান তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। তবে শেখ হাসিনা যে সমস্যায় পড়েছিলেন, সেটি কোনো ছোটখাটো সমস্যা ছিল না। এই অস্থিরতার পেছনে কারণ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল করা।
টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জয় বলেন, “আমরা সবাই কোটা আন্দোলন দেখে অবাক হয়েছিলাম। আসলে আমি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বলেছিলাম, ৩০ শতাংশ কোটা বেশি হয়ে যায়; আমাদের এটা কমিয়ে ৫ শতাংশে নিয়ে আসা উচিত। তখন একজন মন্তব্য করেন, ‘আমরাও মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনি।’ আমি মজা করে বলেছিলাম, ‘এজন্যই তো আমি ৫ শতাংশ রাখতে বলেছি!’”
শেষ পর্যন্ত কোটা ইস্যু অগ্নিশিখার মতো নানান বৈষম্য ও দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দমন-পীড়ন বাংলাদেশের জনসাধারণের ক্ষোভকে উসকে দেয়। জুলাই মাসে এই অস্থিরতা তীব্র আকার ধারণ করে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের সহিংসভাবে দমন-পীড়নের ফলে অন্তত ১ হাজার মানুষ মারা যান।
শেষবার শেখ হাসিনাকে সামরিক হেলিকপ্টারে উঠে দেশ ছাড়তে দেখা গিয়েছিল। সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, ‘তিনি (হাসিনা) দেশের পরিস্থিতি নিয়ে খুবই হতাশ। কারণ গত ১৫ বছরে তার সব পরিশ্রম প্রায় বিফলে যাচ্ছে।’
সংস্কারপন্থীদের আশঙ্কা দেশকে দ্রুত সংস্কারের দিকে নিয়ে যেতে না পারলে আওয়ামী লীগ আমলের নানান দুঃসহ স্মৃতি সাধারণ মানুষের স্মৃতি থেকে ফিকে হতে শুরু করতে পারে।
শেখ হাসিনা দেশে ফিরতে পারবেন কি না অথবা আদৌও ফিরবেন কি না এই নিয়ে জল্পনা-কল্পনা যেন কমছেই না।
উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান, হাসিনার প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারছেন না। কুগেলম্যান বলেন, হাসিনার প্রত্যাবর্তন বেশ সম্ভব। দক্ষিণ এশিয়ার পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাস ঘাঁটুন। দেখবেন, পরিবারতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোকে দেউলিয়া মনে হলেও এ দলগুলোকে একেবারে বাতিলের খাতায় ফেলতে পারবেন না।'
তবে অন্য পর্যবেক্ষকরা হাসিনার প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে কুগেলম্যানের মতো এত আত্মবিশ্বাসী নন।
মুবাশার বলেন, সারা বাংলাদেশে হাসিনার পোস্টার ছেঁড়া হয়েছে, বিকৃত করা হয়েছে। তাকে স্বৈরাচার হিসেবে গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে। তরুণ প্রজন্ম হাসিনার লিগ্যাসিকে এভাবেই দেখছে।
জয় বলছেন, হাসিনা নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্য দেশে ফিরবেন কি না, সে বিষয়ে ‘কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি’।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম যদি স্থবির হয়ে পড়ে, তাহলে যে হাসিনার প্রত্যাবর্তনের সুযোগ বাড়বে, সে বিষয়ে সবাই-ই একমত। ঢাকাভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের মতে, ‘আগামী দশকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হাসিনা ও তার দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগ নেই। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হলে এই প্রেক্ষাপট বদলে যেতে পারে।’
আর ব্যাপক রাজনৈতিকীকরণ হওয়া আমলাতন্ত্র আদতেই সংস্কার বাধাগ্রস্ত করতে চেষ্টা করছে বলেন উল্লেখ করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল শহিদুল হক। তিনি বলেন, সংস্কারে বাধা দিতে হেন প্রচেষ্টা নেই, যা এই প্রশাসন করছে না। তারা এই সরকারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। আর দৃশ্যমান কোনো উন্নতি না হলে মানুষ ধৈর্য হারাবে।
আর জয় এই আশাতেই আছেন। বর্তমান ‘আইনবিহীন’ পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘তারা (অন্তর্বর্তী সরকার) যদি এক বছর বা ১৮ মাস দেশ পরিচালনা করতে চায়, তাহলে ঠিক আছে।’
হাসিনার পতনের পর পুলিশ ও সংখ্যালঘুরদের ওপর ব্যাপক হামলার অভিযোগ উঠলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের উপ-পরিচালক মিনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ‘কোনো দাঙ্গা হয়নি। আমরা সাম্প্রতিক সময়ে বড় আকারের আক্রমণ দেখিনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি ভেঙে পড়েনি।’
এই পরিস্থিতিতে অন্যতম খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ওয়াশিংটন। অন্তর্বর্তী সরকারের আইনগত অবস্থা অস্পষ্ট হওয়ায় মার্কিন সমর্থন আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যোগাযোগ বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন সমর্থনের গুরুত্ব বোঝা গেছে গত মাসে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে হোয়াইট হাউসে ইউনূসের সাক্ষাতের মাধ্যমে।
শহিদুল হক বলেন, ‘মার্কিন সমর্থন অন্তর্বর্তী সরকারের স্থিতিশীলতার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।’
তবে অচলাবস্থা যত দিন চলতে থাকবে, ততই নতুন বয়ান সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। যদিও জয় তার মায়ের দমন-পীড়নের কিছু ভুল স্বীকার করেন, মৃতের সংখ্যা নিয়েও তর্ক করছেন না। তবে তিনি জোর দিয়ে দাবি করছেন, অন্তত অর্ধেক হত্যাকাণ্ড ‘জঙ্গিরা’ ঘটিয়েছে; যারা সম্ভবত ‘বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা’ থেকে অস্ত্র পেয়েছিল।
তবে জয়ের এই দাবির সপক্ষে বলার মতো কোনো প্রমাণ নেই। মিনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ‘পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং আন্দোলন দমনের আদেশ দেওয়ার অসংখ্য ভিডিও রয়েছে।’
দলের নিজ সদস্যদের মধ্যেই সমর্থন ধরে রাখতে পারাটা এখন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের পর দলের প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় নেতা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। ফলে সাধারণ সদস্যদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। মুবাশার বলেন, ‘শেখ হাসিনা যেভাবে চলে গেলেন, তা একদম বিশ্বাসঘাতকতা।’
এছাড়া রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাটের জন্য আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়ছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির তথ্য বলছে, হাসিনার শাসনের ১৫ বছরে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীরা প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে পাচার করেছেন।
৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট জয়ের বাংলাদেশের ব্যাংক হিসাবও ফ্রিজ করেছে। তবে তিনি দুর্নীতির সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমাদের দেখান, টাকা কোথায়? অভিযোগ করা সহজ।’
মিনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন ‘আওয়ামী লীগের উচিত ভুল স্বীকার করা এবং নির্বাচনে লড়ার জন্য একটি গণতান্ত্রিক দল হয়ে ফিরে আসা।’
আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যা’ এবং ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’-এর অভিযোগ প্রমাণিত হলে দলটিকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন অনেকেই। এ দাবি জয়ের কাছে হাস্যকর মনে হয়েছে। টাইমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন এবং বৃহত্তম রাজনৈতিক দলকে কীভাবে নিষিদ্ধ করবেন? এটি আইনিভাবে সম্ভব নয়।’
এমনকি সংস্কারপন্থীরা এবং বিরোধী দলগুলোও নিশ্চিত নয়, একসময় ব্যাপক তৃণমূল সমর্থন পাওয়া একটি দলকে নিষিদ্ধ করে জাতীয় স্বার্থের কোনো লাভ হবে কি না। বর্তমানে মূল লক্ষ্য গত কয়েক দশক ধরে চলে আসা প্রবল রাজনৈতিক প্রতিশোধের এই চক্র থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করা। সূত্র: টাইম ম্যাগাজিন, যুগান্তর
আপনার মতামত লিখুন :