এম এইচ বাচ্চু : শেখ হাসিনার পতনের পর খোঁজ নেই আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতাদের। অনেকে অনেক আগেই বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। অনেকে নাম পরিচ গোপন করে দেশে আত্মগোপনে আছেন। কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী গ্রেপ্তারে তাদের ভেতরে আতঙ্ক আরো বেড়ে গেছে।
আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতাদের মধ্যে ওবায়দুল কাদের, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সেলিম, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম।
তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ সাবেক তিন আইজিপি, বহুল আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ, বিপ্লব কুমারসহ হাই প্রোফাইল ব্যক্তিরা এখন কোথায় এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মানুষের মনে।
এসব নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের অবস্থান নিয়ে নানা ধরনের গুঞ্জন চলছে। তারা কোথায় আত্মগোপন করেছেন? দেশে আছেন নাকি বিদেশে পালিয়ে গেছেন? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে চান ছাত্র আন্দোলনে হতাহতদের পরিবারসহ দেশের অধিকাংশ মানুষ। হাইপ্রোফাইল এসব ব্যক্তির বর্তমান অবস্থানের বিষয়ে কোথাও কোনো তথ্য মিলছে না।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরপরই প্রাণ রক্ষার্থে ঢাকাসহ বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় নেন রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশের কর্মকর্তাসহ আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী বিপুল সংখ্যক ব্যক্তি। সেদিন দুপুরে ঢাকার মিন্টো রোডের মন্ত্রী পাড়ার সরকারি বাসভবন থেকেও বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী আত্মগোপনে চলে যান।
এদিকে রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ কর্মকর্তা ও সরকারের সুবিধাভোগীদের অবস্থান ও অন্তর্ধানের বিষয়ে বিভিন্ন গুঞ্জন শুরু হলে গত ১৮ আগস্ট আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শেখ হাসিনার পতনের পর প্রাণ রক্ষার্থে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিচারক, পুলিশ সদস্যসহ ৬২৬ জন সেনানিবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এর মধ্যে ৬১৫ জন স্ব-উদ্যোগে সেনানিবাস ছেড়েছেন। বর্তমানে ৭ জন সেনানিবাসে রয়েছেন। আশ্রয় দেওয়া ব্যক্তিদের মধ্য থেকে এ পর্যন্ত চারজনকে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বা মামলার ভিত্তিতে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী
আইএসপিআরের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও পুলিশসহ বিভিন্ন ব্যক্তিদের স্ব-উদ্যোগে সেনানিবাস ছাড়ার কথা বলা হয়েছে। তবে তারা এখন কোথায় অবস্থান করছেন এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সংস্থা জানাতে পারেনি।
৫ আগস্টের পর চাকরিচ্যুত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন সশস্ত্র বাহিনীর দুই কর্মকর্তা। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরপরই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে দেশত্যাগের চেষ্টা করেন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য।
গত ৬ আগস্ট সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয়। একই দিনে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদকে ইমিগ্রেশন পুলিশ আটকে দেওয়া হয় বলে একাধিক সূত্র জানায়।
আটক ও আত্মগোপন নিয়ে নানা গুঞ্জন : পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদ অবস্থান করছে সন্দেহে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে রাজধানীর উত্তরা সেক্টর ১০-এর ১২ নম্বর রোডের একটি বাড়ি ঘেরাও করে স্থানীয়রা। তবে সেনাবাহিনী ও পুলিশের সদস্যরা ভবনে তল্লাশি চালিয়ে হারুনকে পাননি। এর আগে গত ৬ আগস্টও হারুন অর রশীদের আটক হওয়ার গুঞ্জন ওঠে। সেদিন তিনি আমাদের সময়কে বলেন, তিনি আটক হননি। বাসাতেই আছেন। তবে এর পর থেকে তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরও বন্ধ।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের অবস্থান নিয়েও নানা কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। কেউ বলছেন দেশে আছেন আবার কেউ বলছেন অনেক আগে তারা বিদেশে চলে গেছে।
ওবায়দুল কাদেরের অবস্থান নিয়ে নানা গুঞ্জন রয়েছে। সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী কী গোয়েন্দা জালে নাকি আত্মগোপনে রয়েছেন, সে বিষয়ে মুখ খুলছে না কেউই। তার সিঙ্গাপুর ও ভারতে পালিয়ে যাওয়ার গুঞ্জন শোনা গেলেও একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, ওবায়দুল কাদের ভারতে কিংবা সিঙ্গাপুরে পালিয়ে যেতে পারেননি। তিনি গোয়েন্দা জালে রয়েছেন।
র্যাবের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মুনিম ফেরদৌস বলেছেন, টিপু মুনশিকে ঢাকার গুলশান এক নম্বর থেকে গ্রেপ্তারের পর গুলশান থানায় সোপর্দ করা হয়। গত জুলাই মাসে রংপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত শ্রমিক মুসলিম উদ্দিন মিলন হত্যা মামলার আসামি তিনি।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র ও গুলি পুরোপুরি উদ্ধার হয়নি। অস্ত্রের লাইসেন্সও স্থগিত করে সেগুলো থানায় জমা দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে। লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি ছাত্র-জনতার হত্যা মামলার আসামি, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজদের ধরতে শিগগিরই যৌথ অভিযান শুরু হচ্ছে।
গ্রেপ্তার হয়নি কোনো পুলিশ কর্মকর্তা : সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গতকাল শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মোট ১০১টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি হত্যা ও লুটপাটের অভিযোগে মামলার আসামি হয়েছেন অর্ধশতাধিক বর্তমান ও সাবেক প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা। বিভিন্ন মামলায় আসামি করা হয়েছে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, একেএম শহীদুল হক, বেনজীর আহমেদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, খোন্দকার ফারুক হোসেন, অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, মীর রেজাউল আলম, হাফিজ আক্তার ও আসাদুজ্জামান, যুগ্ম কমিশনার খন্দকার নুরুন্নবী, সঞ্জিত কুমার রায়, বিপ্লব কুমার সরকার ও মেহেদী হাসানসহ অর্ধশতাধিক পুলিশ কর্মকর্তা। শনিবার (৩১ আগস্ট) পর্যন্ত পুলিশের কোনো কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হননি। তারা দেশেই আছেন, নাকি বিদেশে পালিয়ে গেছেন- সে বিষয়েও তথ্য মিলছে না।
আপনার মতামত লিখুন :