শিরোনাম
◈ রাজধানীর শ্যামপুর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি রনি গ্রেফতার ◈ টাকা না পেয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকে তালা দিলেন গ্রাহকরা ◈ দেখে মনে হয় স্কুল পড়ুয়া কিশোর, বয়স ২২, করেন মাদক ব্যবসা ◈ ৭ কলেজ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রসঙ্গে যা বললেন শিক্ষা উপদেষ্টা ◈ চার ঘণ্টা করে ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকবে ৭০০ যুবক: উপদেষ্টা আসিফ (ভিডিও) ◈ ‘তোমরা রাস্তা বন্ধ করবা, আমরা কি আঙ্গুল চুষবো’ সাধারণ মানুষের আবেগেরই বহিঃপ্রকাশ (ভিডিও) ◈ শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়ার বিষয়ে যা বললেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস ◈ অলিম্পিক ক্রিকেট সরে যাচ্ছে নিউ ইয়র্কে ◈ শান্তকে টেস্ট ও ওয়ানডেতে রেখে টি-টোয়েন্টিতে সোহানকে অধিনায়ক করা য়ায়: আশরাফুল ◈ বিদ্যুৎ, পানি এবং অন্যান্য অবকাঠামো প্রকল্পের ক্ষেত্রে দিল্লির সমর্থনের অভাব রয়েছে : ড. ইউনূস

প্রকাশিত : ১৭ মে, ২০২৩, ১২:৩৩ রাত
আপডেট : ১৭ মে, ২০২৩, ১১:৩৭ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ক্রীতদাস প্রথা এবং মানব ইতিহাসের অন্ধকার যুগ

ফাইল ছবি

সভ্যতার সৃষ্টির পরপরই সামাজিক ব্যাধির মতো চালু হয় ক্রীতদাস প্রথা। এরপর সময় যতো গড়িয়েছে, বেড়েছে তাদের প্রতি অমানবিক নির্যাতনের পরিমাণ। মানুষ হিসেবে নূন্যতম অধিকার কেড়ে নিয়ে এক অভিশপ্ত জীবনে ঠেলে দেওয়া হতো এসব ক্রীতদাসদের। পশুর মতোই ‘পোষ্য’ হিসেবে মনে করা হতো তাদের।

ক্রীতদাস প্রথার ইতিহাস অতি প্রাচীন। যতদূর জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ থেকে ৩০০০ সালে মেসোপটেমিয়ায় প্রথম ক্রীতদাস প্রথার চালু। তারও হাজার খানেক বছর পর থেকে এই প্রথা ছড়িয়ে পড়ে মিশর আর ভারতে। তারও অনেক অনেক পরে চীনে জাঁকিয়ে বসে অমানবিক এই প্রথা । ৮০০ থেকে ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসে এবং ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমে শুরু হয় ক্রীতদাস প্রথার যে চিত্রটির সাথে আমরা সাধারণভাবে পরিচিত তার জয়যাত্রা। এ যেন সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে অসভ্যতার আর অমানবিকতার শীর্ষে উঠবার প্রক্রিয়া। এভাবে প্রায় পুরো বিশ্বজুড়েই ছড়িয়ে পড়ে ক্রীতদাস প্রথা। ওদের কান্না ধ্বনিত হতে থাকে সবখানে, সবসময়। ক্রীতদাস প্রথার প্রথমদিকে এর বিস্তার ছিল কম। উৎপাদনের মূল চালিকা তখনও হয়ে ওঠেনি ক্রীতদাসেরা, দাস বেচাকেনার ব্যবসাটিও শুরু হয়েছে অনেক পরে। কিন্তু মানুষ বরাবরই ভীষণ ‘বুদ্ধিমান’-অমানবিকতার নতুন নতুন কৌশল শিখে নিতে একটুও দেরি হয়নি আমাদের ।

১৪৯৪ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাস পাঁচশো রেডইন্ডিয়ানকে দাস করে পাঠিয়েছিলেন স্পেনের রানী ইসাবেলাকে। ওদের বদলে চেয়েছিলেন শূকর! রানী ইসাবেলা ছিলেন অবশ্য কোমল মনের মানুষ। তিনি এহেন প্রস্তাবে রাজি হননি, ক্রীতদাসদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৭০০ সালে গিনিতে স্পেন আর পর্তুগালরা তো রীতিমত কোম্পানি খুলে বসেছিল, আমেরিকান আর ক্যারাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে বছরে দশ হাজার টন দাস সরবরাহ করবে বলে! মানুষও মাপা হত টনে, নিতান্তই সাধারণ মালপত্রের মত। ১৬৮০ থেকে শুরু করে মাত্র কুড়ি বছরে ইংরেজরা কমসে কম ১,৪০,০০০ মানুষকে রুপান্তরিত করেছিল দাসে। এই সময়কালে অন্যান্য ব্যবসায়ীরাও নিয়োজিত ছিল লাভজনক এই ব্যবসায়। তারাও দাসে পরিণত করেছিল ১.৬০.০০০ মানুষকে। চালাক-চতুর ব্যবসায়ীরা সে সময় আফ্রিকায় গিয়ে সহজ-সরল মানুষদের প্রতারিত করত। আফ্রিকার নানান গোত্রের দলপতিকে তারা দাওয়াত দিয়ে করত ব্যাপক আপ্যায়ন। দিত নানান উপহার। এ সব পেয়ে সব ভুলে নিজ গোত্রের মানুষদেরই ত্রীতদাস বানাতে সহায়তা করত ওই দলপতি। প্রাচীন রোমে তো রীতিমত আইনই করা হয়েছিল যে দাসদের বিক্রি করা যাবে ইচ্ছে মত! পরিসংখ্যান মতে ১৮৬০ সালে দক্ষিণ আমেরিকায় জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশই ছিল ক্রীতদাস। নিজ সমাজ, গোত্র বা ধর্ম সবকিছু নির্বিচারে মানুষ মানুষকে পরিণত করেছে দাসে। দাস ব্যবসা হয়েছে রমরমা। সোনার খোঁজে রেড ইন্ডিয়ানদের কাজে লাগানো হয়েছিল দাস হিসাবে। দুর্ভাগা দাসেরা অবশ্য বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়নি ওই অত্যাচার, তারা বিদ্রোহ করেছিল। এরপর ১৪৯৫ সালে কলম্বাস কঠোর হাতে দমন করেছিলেন ওই বিদ্রোহ, রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল ওই অঞ্চল। আফ্রিকার উপকূলের পাশাপাশি দাস বিক্রির হাট বসত ব্রিটিশ বন্দরেও। ব্যবসা ছিল লাভজনক। উইলিয়াম থিমে নামক এক ব্যবসায়ীর জবানে জানা যায় ১৬১৭ সালে তিনি একাই চালান দিয়েছিলেন ৮৪০ জন দাস। এই দাসদের কেউ কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ ছিলনা, ছিল শ্বেতাঙ্গ। যুদ্ধবন্দীরা তো চিরকাল ধরেই নিগৃহীত, দাস হিসাবেও তাদের ব্যবহার ছিল যেন অবশ্যম্ভাবী। ১৬৫২ সালে ডানবার যুদ্ধে স্কটিশ বন্দীদের মধ্যে ২৭০ জনকে বিক্রি করে দেওয়া হয় বোস্টনে। দাসদের মধ্যে সাদা-কালোর বালাই তখন উঠে গিয়েছিল। যেখানেই মুনাফা সেখানেই হাত বাড়াত লোভী ব্যবসায়ীরা। কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ ভেদাভেদ করে কি হবে।

১৭৫০ থেকে ১৭৫৫। এই পাঁচ বছরে এক নিউ ইয়র্কেই নাকি জাহাজ থেকে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল রোগে-শোকে অত্যাচারে মৃত দু’হাজার শ্বেতাঙ্গ দাসের দেহ। মৃতদেহই যদি হয় দু’হাজার, দাসের সংখ্যা যে কত ছিল সে কথা ভাবতেও ভয় করে। যুক্তরাষ্ট্রের খবরের কাগজগুলোতে প্রকাশিত হত দাস বিষয়ক নানান বিজ্ঞাপন। ১৭১৪ সালে প্রকাশিত হয় একটি বিজ্ঞাপন। যাতে বলা ছিল- ‘ক’জন আইরিশ দাসী আর নিগ্রো বালক বিক্রি হবে!’ তারপর দেওয়া ছিল যোগাযোগ করবার ঠিকানা। ১৭৪৯ সালে বেরিয়েছিল একটি নিখোঁজ সংবাদ। বিজ্ঞাপনটিতে বলা হয়-‘আইজাক ক্রমওয়েল নামে একজন নিগ্রো দাস আর একজন শ্বেতাঙ্গিনী দাসী গ্রীসে পালিয়ে গেছে, কেউ সন্ধান দিতে পারলে দেওয়া হবে পাঁচ পাউন্ড পুরস্কার’। চড়া দামে বিক্রী হত ক্রীতদাস। সিজারের আমলে একজন দাসের দাম ছিল দশ পাউন্ড। আর সে যদি হয় সুন্দরী মেয়ে তা হলে দাম বাড়ত হু-হু করে। একশো পাউন্ড মূল্যেও বিক্রি হত সুন্দরী মেয়ে। তা সত্ত্বেও ধনী আর অভিজাত লোকেদের কমতি ছিল না দাসের। ইতালিতে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ তে মোট জনসংখ্যার ১৫ ভাগই ছিল ক্রীতদাস। এই সংখ্যা বাড়তে থাকে দিন দিন। খ্রিস্টপূর্ব ১০০ অব্দে দেখা গেল দেশের অর্ধেক মানুষই ক্রীতদাস। ক্লডিয়াসের আমলে দাসের সংখ্যা যেখানে ২,০০,৮৩,০০০, সেখানে স্বাধীন মানুষের সংখ্যা মাত্র ৬৯,৪৪,০০০।

১৮০৮ সালের দিকে ,দাস ব্যবসা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় বহুদেশে । কিন্তু তাতে কী, চোরাবাজারে হরদম বেচাকেনা হতে থাকে। দাসের চালান আসত জাহাজের খোলে ভরে । যাত্রার আগে দাসদের সবাইকে খোল থেকে বাইরে এনে মেয়ে-পুরুষ নির্বিশেষে দাড় করানো হত উলঙ্গ করে। তারপর মাথা মুড়িয়ে, লবণ মেশানো পানিতে শরীর ধুইয়ে বসানো হত খেতে। যৎসামান্য খাবার। এরপর বুকে সিলমোহর গরম করে ছ্যাঁকা দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হত বিশেষ চিহ্ন। বিক্রি হয়ে যাবার পর দাসের মালিক আরও একটি চিহ্ন বসাবেন কপালে, একই পদ্ধতিতে, তপ্ত সিলমোহর কপালে বসিয়ে। এভাবে অব্যক্ত যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে মানুষের গায়ে খচিত হত ক্রীতদাসের চিহ্ন। এরপর একজনের পা আর একজনের পায়ে বেঁধে সারি সারি ফেলে রাখা হত ক্রীতদাসদের । শিকলের আরেক প্রান্ত বাঁধা থাকত জাহাজের দেয়ালে, নড়াচড়ার উপায় ছিল না একফোঁটা। দিনে দু’বার দেওয়া হত সামান্য খাবার আর পানি । সামান্যতম প্রতিবাদ করবার চেষ্টা করলেই গায়ে পড়ত নির্মম চাবুক। সপ্তাহে একদিন লোক আসত দাসদের নখ কেটে দিতে। কেউ যাতে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরতে না পারে কিংবা ধারাল নখ দিয়ে শিরা কেটে আত্মহত্যা করতে না পারে। মৃত্যু তো রুখতেই হবে, কারণ দাস মানেই কাঁচা পয়সা, দাসের মৃত্যু মানেই লোকসান । জাহাজের খোলগুলো ছিল মাত্র দু’ফুট উঁচু। তার ভিতর অবিশ্বাস্য ভাবে গাদাগাদি করে থাকতে হত ক্রীতদাসদের । ১৮৪৭ সালে ‘মারিয়া’ নামের একটি জাহাজের পঞ্চাশ ফুট দীর্ঘ আর পঁচিশ ফুট চওড়া একটি খোলে পাওয়া গিয়েছিল ২৩৭ জন দাস। ‘ব্র“কস’ জাহাজের একশো ফুট লম্বা আর পঁচিশ ফুট চওড়া একটি খোলে ঢোকানো হয়েছিল ৬০৯ জন দাস। ব্র“কস-এর ক্যাপ্টেন খোলের ভিতর বসিয়েছিলেন আরও একটি তক্তা, তাতে দু’ফুট উঁচু খোলে ধরানো হয়েছিল দু’প্রস্থ মানুষ। সোজা হয়ে শোয়া তো দূরের কথা, পাশ ফিরবারও উপায় ছিল না কোনও। এভাবে ব্র“কস-এর দাসদের থাকতে হয়েছিল টানা দশ সপ্তাহ । মল-মূত্র-কফ-থুথু-বমি সব জড়ো হত ওখানেই। দোযখ কী একেই বলে?

এমন অনাচার সহ্য না করতে পেরে অনেক সময়ই আত্মহত্যা করতে চাইত ক্রীতদাসেরা। তারা খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিত মরবে বলে । কিন্তু এত সহজে তো লোকসান দিতে রাজি নয় জাহাজের ক্যাপ্টেন। তাই প্রত্যেক জাহাজেই রাখা হত বিশেষ একটি যন্ত্র, যার সাহায্যে দাসের ঠোঁট কেটে দাঁত ভেঙে পেটে নল ঢুকিয়ে খাইয়ে খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখা হত তাদেরকে। একবার এক শিশু দাস কোনমতেই খেতে রাজি না হওয়ায় চাবুক মেরে হত্যা করা হয় তাকে। তারপর ওই শিশুর মাকে বাধ্য করা হয় সন্তানের মৃতদেহটিকে সাগরের বুকে নিক্ষেপ করতে। শাস্তি দেবার জন্য খোলের ভিতর বন্দী দাসেদের শরীরে নল দিয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হত ফুটন্ত পানি। ১৮৪৪ সালে ‘কেন্টাকি’ জাহাজের দাসেরা বিদ্রোহ করলে নির্মম ভাবে দমন করা হয় ওই বিদ্রোহ। কাউকে গলায় দড়ি দিয়ে, কাউকে গুলি করে মেরে কিংবা জীবন্ত অবস্থাতেই স্রেফ সাগরের পানিতে ছুঁড়ে ফেলে। এমনতর কাহিনীর যেন শেষ নেই কোনও। ‘ব্রিলান্ত’ জাহাজের ক্যাপ্টেন হোমানস দাস ব্যবসা করত লুকিয়ে-চুরিয়ে। কেননা তখন দাস ব্যবসাকে করা হয়েছে বে-আইনী। এমনই এক চালানের সময় তার জাহাজের পিছু নিল ব্রিটিশ নৌবাহিনীর চারটি জাহাজ। হোমানস দেখল মহা বিপদ, তার জাহাজের খোল ভর্তি ক্রীতদাস, ধরা পড়লে তো আর রক্ষা নেই। বিপদ থেকে রক্ষা পাবার জন্য যে কাণ্ডটি ঘটাল ক্যাপ্টেন হোমানস, ইতিহাসে নির্মম ঘটনার তালিকা তৈরি করলে সেটি নিঃসন্দেহে এগিয়ে থাকবে সামনের দিকে। ৬০০ জন দাসকে পরপর মালার মত বাঁধলেন একে অন্যের সাথে, তারপর জাহাজের সবগুলো বড়বড় নোঙর বেঁধে তাদেরকে ডুবিয়ে দেওয়া হলো সাগরের পানিতে। নৌ-বাহিনীর লোকেরা জাহাজ পরীক্ষা করে ফিরে গেল সন্তুষ্ট হয়ে-নাহ! ওই জাহাজে কোন ক্রীতদাস নেই! পেছনে পরে রইল ৬০০ মৃত মানুষের মালা। তবে, নানান সময়ে বিদ্রোহ করেছে ক্রীতদাসেরা। সিসিলি দ্বীপের ইউনোস আর ক্লেওন-এর বিদ্রোহ, চীনের ‘লালভ্র“ বিদ্রোহ’, ইতালির স্পার্টাকাসের রুখে দাড়ানো-এমনতর নানা বিপ্লবের কথা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। এমনকী আমাদের সবার চেনা নাম ‘রাজিয়া’ যার পুরো নাম রাজিয়াতউদ্দিন, তিনি অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন দিল্লীর মসনদে। দিল্লীর মসনদে প্রথম মহিলা তিনি। এই সুলতানা রাজিয়ার পিতা ছিলেন একজন ক্রীতদাস। ইলতুতমিস। ইলতুতমিসের পূর্বসুরি কুতুবউদ্দিন আইবেকও ছিলেন একজন ক্রীতদাস, যিনিও বসেছিলেন দিল্লীর মসনদে।

১৭৫৩ সালে কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের মূল্য ছিল গড়ে পঁয়ত্রিশ পাউন্ড। ১৭৮৬ সালে লিভারপুলের একটি কোম্পানির ৩১,৬৯০ জন দাসকে বিক্রি করে লাভ হয়েছিল ২, ৯৮,৪৬২ পাউন্ড। দাম দিন দিন বাড়তে থাকে দাসদের। ১৭৮০ সালে দক্ষিণ আমেরিকায় একজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসের দাম ছিল যেখানে দু’শো ডলার, সেটি ১৮১৮ সালে হয়ে দাঁড়ায় এক হাজার ডলার, ১৮৬০ সালে দাম বেড়ে হয় আঠারোশো ডলার। এহেন লাভজনক ব্যবসা কেই বা হেলায় হারাতে চায়। এজন্য ১৫১৯ থেকে ১৮০৭ সাল পর্যন্ত আমেরিকার উপনিবেশগুলোতে আফ্রিকা থেকে দাস আনা হয়েছে কমসে কম ৫০,০০,০০০। মানুষ বেচাকেনার জন্য হাট-ও তো চাই। এথেন্স, রোমের পাশাপাশি দিল্লী, গোয়া, কলকাতা, হুগলীতেও বসত ক্রীতদাসের হাট। দিল্লীতে যখন চোদ্দ সের গমের দাম তিন আনা, তখন একজন ক্রীতদাস শ্রমিকের দাম ছিল দশ-পনের টাকা। দাস যদি হয় শিক্ষিত-সুদর্শন বালক তা হলে তার মূল্য কুড়ি টাকা। রুপসী মেয়ে দাসের দাম বেশি, কুড়ি থেকে চৌত্রিশ টাকা। দারিদ্রের চাপে পড়ে কিংবা ঋণ শুধতে না পেরে অনেকে তাদের নিজেদের বিক্রি করে দিত দাস হিসাবে। ১৮৬২ সালের হিসাবে আসামে ছিল ২৭,০০০ দাস, চট্টগ্রামে ছিল ১,২৫,০০০ দাস। দাম ছিল গড়ে কুড়ি টাকা। এ অঞ্চলের বেশির ভাগ দাস ছিল এখানকারই নিজস্ব অধিবাসী। কিছু বিদেশী ক্রীতদাসও আসত। কলকাতাতে প্রতিবছর আসত প্রায় ১০০ ভিনদেশী দাস। ১৮৩০ সালের এক সংবাদপত্রের প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় যে অযোধ্যঅর নবাব চড়া দামে কিনেছিলেন ৫ জন সুন্দরী বিদেশী মেয়ে আর ৭ জন ভিনদেশী পুরুষ। দাম পড়েছিল কুড়ি হাজার টাকা। ১৭৮০ সালে প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছিল -‘কলকাতা নিবাসী এক ভদ্রলোকের জন্য দু’টি তাম্র বর্ণের সুন্দরী আফ্রিকান রমণী চাই’। পলাতক ক্রীতদাস ধরে দেবার জন্য পুরস্কার ঘোষণারও নজির রয়েছে অনেক। ওয়ারেন হেস্টিংস সাহেব তো রীতিমত নিয়ম করে দিয়েছিলেন যে কোন দাস কিনবার সময় আদালতে রেজিস্ট্রি করাতে হবে। কলকাতয় এই ফি ছিল প্রতি দাস প্রতি ৪ টাকা ৪ আনা। এই অঞ্চলের বেশির ভাগ দাসই হয় দুর্ভিক্ষের কারণে নিজেদের বিক্রি করে দিয়েছিল অথবা ছিল নিচু শ্রেণীর মানুষ, কিংবা ছেলে ধরার হাতে ধরা পড়া বাচ্চারা। বাংলার সুলতানেরা অবশ্য আফ্রিকা, তুর্কিস্তান, পারস্য আর চীন থেকেও কিনে আনাতেন দাস। ১৮৩০-এর সশকের শেষভাগে আফ্রিকা থেকে আনা ‘হাবসী’ আর ‘কাফ্রি’ ক্রীতদাসদের দাম ছিল সবচেয়ে বেশি । হিন্দু সমাজে টাকা দিয়ে কেনা দাসদের ডাকা হত ‘ক্রীতদাস’ বা ‘দাস’ নামে আর মেয়ে ক্রীতদাস-এর নাম ছিল ‘দাসী’। মুসলিম সমাজে পুরুষ ক্রীতদাসদের নাম ছিল ‘গোলাম’ বা ‘নফর’ আর মেয়ে ক্রীতদাসের পরিচয় ছিল ‘বাঁদী’ নামে। তাছাড়া সুন্দরী বাঁদীদের দাম আর চাহিদাও বেশি। যৌন সম্ভোগের উপকরণ হিসাবে বাঁদীদের গর্ভের সন্তানও হত দাস। মহাজনদের দেনা শোধ করতে না পেরেও অসংখ্য মানুষ নিজেদের বিক্রি করে দিত দাস হিসাবে। সিলেট, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম আর ঢাকা অঞ্চলে ১৮৩৯ সালের আইন কমিশনের রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে ওখানকার এক পঞ্চমাংশ মানুষই ছিল এমনতর ক্রীতদাস। অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে এসে ক্রীতদাস প্রথা বন্ধ হতে থাকে। আমাদের এই অঞ্চলে ১৮৪৩ সালের পাঁচ নম্বর অ্যাক্ট-এর মধ্য দিয়ে ক্রীতদাস প্রথা বন্ধের পথটি সুগম হয়।

কাগজে-কলমে ক্রীতদাস প্রথা এখন আর নেই। কিন্তু ধনী মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে আজীবন ধরে ঋণগ্রস্ত থাকবার প্রক্রিয়া চলে বংশ পরম্পরায়। এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাতিন আমেরিকার অনেক দেশের এমন প্রথাকে বলা যেতে পারে ‘নতুন মোড়কের ক্রীতদাস’। তা ছাড়া কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি আচরণ এখনও অনেক দেশেই ক্রীতদাস প্রথারই নামান্তর মাত্র। অনেক বর্ণ বা গোত্রের মানুষ এখনও বহন করে দাসের মত দুঃসহ জীবন। সৌদী আরবে ১৯৬২ সালে ক্রীতদাস প্রথা নিষিদ্ধ হয়ে, কিন্তু ১৯৬৩ সালে সৌদী সরকার ঘোষণা দিয়ে নির্ধারণ করে দেয় ক্রীতদাসের দাম। সেখানে ঠিক করা হয় যে পুরুষ ক্রীতদাস আর মেয়ে ক্রীতদাসের মূল্য হবে যথাক্রমে সর্বোচ্চ ২৫০ পাউন্ড স্টার্লিং এবং ৩৫০ পাউন্ড স্টার্লিং। এমনতর নানান বৈপরীত্য এখনও চলছে সমান তালে।

যেসব অতীত নিদর্শন দেখে আমরা মোহিত হই, বিস্মিত হই সভ্যতার অগ্রযাত্রায়, তার অনেকগুলোতেই লেগে থাকে ক্রীতদাস শ্রমিকের ঘাম, রক্ত আর মৃত্যুর করুণ ইতিহাস। ভারত আর রোমের অনেক স্থাপত্য, রোমের বিখ্যাত সব রাস্তা, থিয়েটার, চীনের গ্রেটওয়াল, মিশর আর মেক্সিকোর পিরামিড-এসব কিছুই নির্মিত হয়েছে ক্রীতদাসদের হাতে। এই সব স্থাপত্যের প্রতিটি গাঁথুনিতে মিশে আছে ক্রীতদাসের হাহাকার। এই সব চোখ ধাঁধানো স্থপত্যগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে সভ্যতা মানে শুধু ঝলমলে আলোই নয়, কখনও কখনও নিকষ কালো অন্ধকারও।

তথ্যসূত্র:

১. ক্রীতদাস: শ্রীপান্থ।

২. পৃথিবীর ইতিহাস-প্রাচীনযুগ: ফিওদর করোভকিন।

৩. Bangla pedia: Asiatic Society of Bangladesh.

৪. What is political economy? : Ilyin, Motylev.

৫. Fundamentals of political Economy: Ryndina, Chernikov.

৬. Political Economy-Capitalism: Kozlov.

প্রকাশকাল: ২২ শে আগস্ট, ২০০৯ 

Somewhere in the blog সাইট থেকে

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়