আনন্দবাজার: যেখানে দশ জন মহিলা কর্মীর ন’জনই নিযুক্ত অসংগঠিত ক্ষেত্রে, যেখানে মজুরি অত্যন্ত কম, কাজের সময় আট থেকে দশ ঘণ্টা, এবং পেনশন প্রভৃতি সামাজিক সুরক্ষা শূন্য।
পাঁচ বছরে দশ মিনিট। এতটুকুই কমেছে ভারতের মেয়েদের বেতনহীন গৃহকাজের সময়। কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রকের সাম্প্রতিক রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০১৯ সাল থেকে ২০২৪, এই সময়কালে মেয়েদের অবৈতনিক গৃহকাজ কমেছে দিনে ৩১৫ মিনিট থেকে ৩০৫ মিনিট। সাংসারিক কাজ কিংবা শিশু-বয়স্কদের পরিচর্যার কাজ, দুটোতেই পুরুষরা ব্যয় করেন মেয়েদের সময়ের অতি সামান্য অংশ। অন্য দিকে, রোজগার হয়, এমন কাজে পুরুষরা ব্যয় করেন মেয়েদের চেয়ে দৈনিক ১৩২ মিনিট বেশি। এ থেকে দুটো জিনিস ফের বোঝা যায়। এক, পুরুষরা সাংসারিক কাজের বোঝা মেয়েদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে অনিচ্ছুক। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এর কোনও পরিবর্তন ঘটছে না। দুই, ঘর ও বাইরে মেয়েদের কাজের বোঝা কমার কোনও ইঙ্গিত মিলছে না। ১৫-৫৯ বয়সি মেয়েরা ৩০৫ মিনিট ঘরের কাজ এবং ৩৪১ মিনিট বাইরের কাজ করেন, অর্থাৎ প্রায় পৌনে এগারো ঘণ্টা। এ হল মেয়েদের কাজের গড় সময়, যার মানে বহু মেয়ে আরও বেশি সময় কাজ করেন। ভারতে মেয়েদের কর্মনিযুক্তির হার সামান্য হলেও বাড়ছে। কিন্তু মেয়েদের দৈনন্দিন কাজের এই বিপুল বোঝার কথা মাথায় রাখলে প্রশ্ন জাগে, রোজগারের সুযোগ মেয়েদের কাছে কতটুকু মুক্তির সুযোগ নিয়ে আসছে? আরও উন্নত, সুস্থ, স্বচ্ছন্দ জীবনের প্রতিশ্রুতি দিতে পারছে কি? বিশেষত যেখানে দশ জন মহিলা কর্মীর ন’জনই নিযুক্ত অসংগঠিত ক্ষেত্রে, যেখানে মজুরি অত্যন্ত কম, কাজের সময় আট থেকে দশ ঘণ্টা, এবং পেনশন প্রভৃতি সামাজিক সুরক্ষা শূন্য।
মেয়েদের ঘরের কাজে মাত্র দশ মিনিটের হ্রাস দেখিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার বাহাদুরি কুড়োতে চাইছে। তা নাকি মেয়েদের রোজগার-নিযুক্তির প্রমাণ। পুরুষদের গৃহকাজে নিযুক্তি কতটা বাড়ল, আদৌ বাড়ল কি না, না বাড়লে কেন বাড়েনি, তা নিয়ে একটা কথাও উচ্চারণ করছে না সরকার। বরং ভারত সরকারের একটি বিজ্ঞপ্তি মেয়েদের বেতনহীন গৃহশ্রমকে ব্যাখ্যা করেছে ‘ভারতীয় সমাজের গঠন’ দিয়ে, যেখানে মহিলারাই গৃহস্থালি ও পরিচর্যার কাজ করেন। লিঙ্গবৈষম্য, বর্ণবৈষম্যকে ‘ঐতিহ্য’ বলে চালিয়ে দেওয়ার এই চেষ্টা বিরক্তিকর। সরকারি নীতির নিরিখে দেখলে তা স্ববিরোধীও বটে, কারণ মেয়েদের নানা পেশায় প্রশিক্ষণ, ইন্টার্নশিপ, ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোগের জন্য ঋণ, প্রভৃতির জন্য বিপুল বিনিয়োগ এবং বরাদ্দ করছে সরকার। গৃহকাজের বোঝায় মেয়েরা যদি সেই সব সুযোগের যথেষ্ট ব্যবহার করতে না পারেন, তা তো করদাতার টাকার অপচয়। বহু অর্থনীতিবিদ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, ভারতের কর্মক্ষম বয়সের মেয়েরা আরও বেশি সংখ্যায় শ্রমের বাজারে যোগ দিলে ভারতের জিডিপি আরও কতগুণ বাড়তে পারত। সে সব সদুপদেশ ‘কথার কথা’ হয়েই রয়ে গিয়েছে। ভারত সরকার বরং পরিসংখ্যানে নানা হাতসাফাই করে মেয়েদের অবৈতনিক শ্রমকেও কর্মনিযুক্তির মধ্যে দেখিয়ে শ্রমের বাজারে মেয়েদের যোগদানকে (২০২৩-২৪) ৩৭ শতাংশ করে দেখিয়েছে। পুরুষদের গৃহকাজ-বিমুখতা যে সাম্যময় ভারত গড়ার পরিপন্থী, এ কথাটা স্বীকার করার ‘পৌরুষ’ কোনও রাজনৈতিক দলের নেই।
সামাজিক সংস্কারের অভাব আপাতত পূরণ করতে হবে সরকারি প্রকল্প দিয়ে। শিশু-বৃদ্ধের পরিচর্যার জন্য সরকারি প্রকল্প দরকার, তার পরিকাঠামো গড়তে বিনিয়োগ করতে হবে। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিতে ক্রেশ চালু করার নীতিকে সার্বিক রূপ দিতে হবে। কর্মরত মায়েদের শিশুদের জন্য হস্টেল, বয়স্কদের সহায়তা ও পরিচর্যার জন্য প্রতিষ্ঠান, এ সবই গড়া দরকার। পাশাপাশি, সুলভে স্বাস্থ্যকর খাবার, সুলভ পরিবহণ প্রভৃতিও চালু করতে হবে, যাতে মেয়েদের কর্মনিযুক্তি সহজ হয়। দক্ষ, পরিশ্রম-উন্মুখ মেয়েরা ভারতের এক অপরিমিত মানবসম্পদ। ‘ঐতিহ্য’-এর দোহাই দিয়ে কেবল দৈনন্দিন কায়িক শ্রমের পুনরাবৃত্তিতে তাকে আবদ্ধ রাখলে দেশেরই ক্ষতি হয়।