ডেস্ক রিপোর্ট : ডলফিনের একটি প্রজাতি বাংলাদেশে শুশুক নামে পরিচিত। এছাড়া বাংলাদেশের নদীগুলোয় প্রায়শই সাগরের ডলফিন ধরা পরে। আর ডলফিন ধরা পড়লেই এদেশের মানুষের প্রধান ও প্রাথমিক কাজ হচ্ছে তাকে মেরে ফেলা। তবে মানুষের এই মানসিকতার কারলে ধংস হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। এর নানারকম ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবনে।
ডলফিন জলজ পরিবেশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী। যে নদীতে ডলফিন থাকে সেই নদীতে মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং নদীর পরিবেশ সুস্থ থাকে। এদের উপস্থিতি পানির গুণগত মান বা অবস্থা পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। পরিবেশগত প্রভাব বোঝার নির্দেশক এই ডলফিন বর্তমানে ভালো নেই। বাংলাদেশে এরা বিপন্ন প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত। দিনের পর দিন সংখ্যা কমে আসছে। অপরিকল্পিত বাঁধ তৈরি, মিঠাপানির প্রবাহ কমে যাওয়া, নির্বিচারে হত্যা, মাছ ধরার জালে আটকে মৃত্যুর কারণে এদের অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে।
বিশ্বের বহুস্থানেই দেখানো হলো ডলফিনের ভিন্ন ভিন্ন খেলা। এরা জেলেদের বন্ধু। মাছ শিকারে জেলেদের সহায়তা করে। জেলেরা যখন জাল টানে তখন এরা লাফিয়ে পড়া মাছ অনায়াসে শিকার করে খায়। এদের চলাচলের গতি-প্রকৃতি দেখে জেলেরা মাছের ঝাঁকের অবস্থান বুঝতে পারে। নদী কিংবা সাগরে বিপদে পড়া মানুষকে উদ্ধার করে এরা পাড়ে নিয়ে আসে। সামাজিক প্রাণী হিসেবে এদের কেউ বিপদে পড়লে দলেবলে তাকে রক্ষা করে। এরা একে অপরের সঙ্গে নির্দিষ্ট আওয়াজ করে যোগাযোগ করতে পারে। এ আওয়াজ জন্মের প্রথম বছরই শিখে নিয়ে সারাজীবন ব্যবহার করে। এছাড়া আরও প্রায় ১০ রকম আওয়াজ এরা আয়ত্ত করে থাকে। স্ত্রী ডলফিন ২ থেকে ৩ বছর পরপর বাচ্চা দেয় এবং প্রধানত মা-ই সব দায়িত্ব পালন করে।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, ডলফিনের নানা ধরনের খেলা দেখানোর মাধ্যমে রোগীদের থেরাপি দেওয়া হয় এবং রোগীরা এতে সুস্থ হয়ে যায় বলে জানা যায়। সবচেয়ে বড় উপকার হলো এরা যখন মাছ শিকার করে তখন রোগাক্রান্ত, দুর্বল ও বিকলাঙ্গ মাছগুলো সহজে ধরতে সক্ষম হয় এবং অন্যান্য মাছের সুস্থতা রক্ষা করে। ডলফিনকে বলা হয় পরিবেশের সুস্থতার নির্দেশক। অথচ বর্তমানে গাঙ্গেয় ডলফিন বা শুশুক বিলুপ্ত প্রায় একটি প্রজাতি, যার সংখ্যা পৃথিবীতে ১২ থেকে ১৮শ’। ডলফিন শুধু সমুদ্র ও নদীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে না, বরং আমাদের পরিবেশের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডলফিন মানুষের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত জীবনের অংশ। বাংলাদেশের সুন্দরবন ও উপক‚লীয় অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে ডলফিন ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আজ ২৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিক মিঠাপানির ডলফিন দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘নদীর প্রাণ ডলফিন-শুশুক, নিরাপদে বেঁচে থাকুক’। জলজ প্রতিবেশের অন্যতম প্রাণী ডলফিন। এরা এদেশে শুশুক, শিশু ও শিশুমাছ নামেও পরিচিত। দেশের অভ্যন্তরীণ বড় বড় নদী, মোহনা ও সুন্দরবনের নদীগুলোতে এদের দেখা যায়। নদীর মাঝারি গভীরতায় থাকতে এরা পছন্দ করে। ধূসর রঙের এই প্রাণীটির মাথা ছোট ও শরীর বেশ নরম। এদের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো লম্বা ঠোঁট। ছোট ছোট চোখ দুটি ঠোঁটের উপর অবস্থিত হলেও এরা এটা দিয়ে খুব ভালো দেখতে পায় না। এরা একাকী, জোড়ায় জোড়ায় থাকে এবং মাঝে মাঝে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য পানির উপর উঠতে দেখা যায়। জলজ জীব-বৈচিত্র্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে ডলফিন বা শুশুক।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে, ডবিøউসিএস বাংলাদেশ গাঙ্গেয় ডলফিনের ওপর ব্যাপক পর্যালোচনা ও গভীরতার সমীক্ষা পরিচালনা করে। বাংলাদেশ মেঘনা ও এর শাখা নদী, পদ্মা, যমুনা, কর্ণফুলী এবং হালদা নদীর ১ হাজার ৯০৫ কিমি এলাকাজুড়ে নদীর ডলফিনের ভিজ্যুয়াল বোট-ভিত্তিক সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়। দুটি স্বাধীন পর্যবেক্ষক দল দ্বারা সমীক্ষা চালানো হয়। এই সমীক্ষার ফলে প্রায় ৬৩৬টি দল বা ১ হাজার ৩৫২টি গাঙ্গেয় ডলফিনের উপস্থিতি নির্ধারণ করা হয়।
১৯৯৬ সালে সুন্দরবনে তিনটি অভয়ারণ্য ও ২০১২ সালে তিনটি ডলফিন অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং ২০১৪ সালে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডকে মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। গবেষকরা বলছেন, সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে রয়েছে তিমি, ডলফিন, হাঙরসহ বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণীর অভয়ারণ্য। সুন্দরবন থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত সাবমেরিন ক্যানিয়ন বা ‘সোয়াচ অব নো-গ্রাউন্ড’কে বলা হয় ডলফিনের স্বর্গ। সোয়াচ অব নো-ল্যান্ড হলো সুন্দরবনসংলগ্ন বঙ্গপসাগরের মুখে গড়ে ওঠা ১৪ কিলোমিটার চওড়া এবং সমুদ্রের তলদেশ থেকে হাজার মিটারের বেশি গভীর এক প্রাকৃতিক খাত (ক্যানিয়ন), যার গভীরতা পরিবর্তনশীল। যে কেউ একে চিনতে সক্ষম কারণ এ এলাকার পানির রংয়ের আশপাশের পানির রং থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সুন্দরবনে তিন ধরনের ডলফিন ও এক প্রজাতির পাখনাবিহীন শুশুক পাওয়া যায়।
ইরাবতী ডলফিনের পিঠে ছোট ত্রিকোণ একটি পাখনা আছে। যার অগ্রভাগ প্রায় গোলাকৃতি ও ভোঁতা। এদের ঠোঁটহীন মাথাও ভোঁতা। সোজা মুখাবয়ব এবং ঘাড়ের কাছে ভাঁজ সদৃৃশ্যমান। পূর্ণবয়স্ক ইরাবতী ডলফিন আকারে দুই থকে ২.৭৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এদের পিঠ ও পাশের রং ধূসর ও নীলাভ-ধূসর এবং পেটের রং কিছুটা হালকা। এরা দলবদ্ধ প্রাণী। ইরাবতী ডলফিন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপ-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের উপক‚লীয় লবণ ও মিঠাপানিতে বাস করে। উত্তর অস্ট্রেলিয়া ও নিউগিনি থেকে বঙ্গোপসাগর এবং ইরাবতী নদী মেকং নদী, মহাকাম নদী, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীতে ইরাবতী ডলপিন দেখতে পাওয়া যায়।
সুন্দরবনে রয়েছে বিপন্ন প্রায় আরেক প্রজাতির গোলাপি ডলফিন। এ গোলাপি ডলফিনকে কেউ বলে ডানাকাটা পরী, আবার কেউ বলে সাগরের রাজকন্যা। একসময় হারহামেশায় দেখা মিললেও এখন বঙ্গোপসাগরে ও মোহনায় কালেভদ্রে এদের দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। ২০০২ সালেও ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির একটি জরিপে বাংলাদেশে গোলাপি ডলফিনের অস্তিত্ব পাওয়ার কথা জানায়। পৃথিবীজুড়ে গোলাপি ডলফিনকে বিপন্নপ্রায় প্রজাতি হিসেবে মনে করা হয়। ব্যতিক্রমী গায়ের রং ছাড়া এই ডলফিনের আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে এর আকৃতি ও ওজন। পৃথিবীতে যে আট প্রজাতির ডলফিন আছে, তার মধ্যে এটি সবচেয়ে বড় ও বিরল।
প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞ ড. অধ্যাপক সুরঞ্জন দেবনাথ বলেন, নদী ও উপক‚লীয় এলাকায় ডলফিনের সংখ্যা হ্রাস প্রতরোধে এবং ডলফিনের আবাসস্থল রক্ষায় ‘ডলফিন কনজারভেশন অ্যাকশন প্ল্যান’ কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। শীতকালে গাঙ্গেয় ও ইরাবতী ডলফিন দেশের যেসব স্থানে পাওয়া যায় ‘ডলফিন এটলাস ইন বাংলাদেশ’ তা জানাতে সহায়তা করবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, নদীর নাব্য হ্রাস, পাশাপাশি কল-কারখানার তরল বর্জ্যতে পানি দূষণ এদের বিপন্নতার অন্যতম কারণ। ডলফিন তেলের উপকারিতা নিয়ে লোকজ কুসংস্কারের কারণেও এরা মানুষের হাতে মারা পড়ছে। মিঠাপানির ডলফিন বাঁচলে সুস্থ থাকবে জলের আধার; রক্ষা পাবে অন্যান্য জলজপ্রাণী, সেই সঙ্গে নিশ্চিত হবে টেকসই জলজপ্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়কারী ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরীয়া জানান, বিপন্নপ্রায় মিঠা পানির গাঙ্গেয় ডলফিনের গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল হালদা নদী। ডলফিনগুলো এই এলাকার বাস্তুতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে গত কয়েক বছর ধরে নদী থেকে উদ্বেগজনক হারে বিলুপ্ত হচ্ছে প্রজাতিটি। যেসব কারণে প্রাণীটি বিপন্নপ্রায় হয়ে পড়েছে, তার বেশিরভাগই মানবসৃষ্ট। বাংলাদেশে গঙ্গা নদীর ডলফিনসহ অন্যান্য প্রজাতির ডলফিন বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো নদীর দূষণ, অপ্রয়োজনীয় মাছ ধরার জাল, জলবিদ্যুৎ বাঁধ, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদীর প্রবাহে পরিবর্তন। এদের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে, যা আমাদের বাস্তসংস্থানকে ঝুঁকিতে ফেলছে। ডলফিন সংরক্ষণ কেবল একটি প্রজাতি সংরক্ষণ নয়, বরং আমাদের পরিবেশের সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। যখন ডলফিনকে রক্ষা করা হয়, তখন তা জলজ পরিবেশের অন্যান্য প্রাণীদের জন্যও উপকার বয়ে আনে।
পরিবেশ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দেশব্যাপী ডলফিন সংরক্ষণ কার্যক্রম আরও জোরদার করা ও মিঠাপানির ডলফিন সংরক্ষণে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে বাংলাদেশ সরকার। গবেষণা, ডলফিনের গতিবিধি ও স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ এবং প্রজনন সংক্রান্ত উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন নদীতে পর্যটন নিয়ন্ত্রণ ও নদীদূষণ রোধে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ বাড়ানো হয়েছে।
সুত্র : যায় যায় দিন
আপনার মতামত লিখুন :