আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাহারা না থাকায় অরক্ষিত হয়ে পড়েছে দূতাবাস এলাকা। এ কারণে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন ঢাকায় থাকা কূটনীতিকরা। গত কয়েক দিন ধরে এ এলাকার বাসাবাড়ি ও অফিসে আগুন এবং ভাঙচুরের ঘটনায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না। এ ছাড়া বাংলাদেশ পরিস্থিতির বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চাচ্ছেন তারা। কিন্তু সরকার না থাকায় কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারছে না পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সূত্র : সমকাল
গত মঙ্গলবার সকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সব কর্মকর্তার বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়ে নির্দেশনা দিতে এক সভার আয়োজন করা হয়। এতে পররাষ্ট্র সচিবের পরিবর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অনুবিভাগের সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম নির্দেশনাগুলো কর্মকর্তাদের জানিয়ে দেন।
নিরাপত্তাহীনতায় ইতোমধ্যে পরিবারসহ নিজ দেশে ফেরত গেছেন ভারতীয় কূটনীতিকরা। এখন শুধু হাইকমিশনার ও প্রয়োজনীয় কর্মকর্তারা রয়েছেন। ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস জানায়, জঙ্গি হামলার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া সংঘাত ও সহিংসতার কারণে বাংলাদেশে ভ্রমণের সতর্কতা জারি করেছে দেশটি।
এখানে সব ধরনের অপরাধের সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানানো হয়। এ ছাড়া ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে পড়তে আসা বিদেশি কূটনীতিকরাও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। একাডেমির গেট বন্ধ রাখা হচ্ছে। কূটনীতিকদের নিরাপত্তার কারণে বাইরে যেতে নিষেধ করা হচ্ছে। এ ছাড়া রাতে একাডেমির লাইট বন্ধ রাখতেও বলা হয়েছে।
গতকাল বুধবার কূটনীতিকপাড়ায় ঘুরে দেখা যায়, কোনো দূতাবাস বা হাইকমিশনের সামনে পুলিশ বা পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের উপস্থিতি নেই। মাঝে মাঝে সেনাবাহিনীর টহল দেখা গেছে। নিজেদের নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে আপাতত অবস্থা সামাল দিচ্ছে মিশনগুলো।
গত মঙ্গলবার কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভায় খুরশেদ আলম বলেন, আপনারা দেখেছেন অনেক দূতাবাস থেকে অনেক কূটনীতিকরা এসেছিলেন বিভিন্ন কাজ নিয়ে। আমাদের এ নিয়ে খুব একটা সমস্যা হয়নি, আমরা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্পত্তি দেখাশোনার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এখন একটা অস্থির পরিস্থিতি চলছে, কী হবে না হবে তা ধীরে ধীরে প্রকাশ পাবে। বাইরের মানুষের মতামত আপনি জানতে পারেন। তবে নিজের মতামত দেবেন না।
সাবেক এই রিয়ার অ্যাডমিরাল বলেন, আমাদের দেশে যে ঘটনা ঘটেছে, তা কিন্তু প্রথম নয়। আমি ১৯৯৬ সালে দেখেছি, তখন এভাবে ক্ষমতা থেকে চলে গিয়েছিল। এ ছাড়া ১৯৭০, ১৯৭১ সালে হয়েছে, কিন্তু দেশের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হয়নি। কিন্তু প্রতিক্রিয়া হয়েছে ১৯৯১ সালে। ১৯৯১ সালে যখন সরকার পরিবর্তন হলো, এরশাদ চলে গেলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলো, তখনও কিন্তু এ রকম মারামারির ঘটনা ঘটেছে। রাষ্ট্রযন্ত্র সবার নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিতে ব্যর্থ হয়েছে। এটা আমরা অতীতেও দেখেছি। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই সোমবার যা হয়েছে, তা প্রথমবার বাংলাদেশে হয়েছে।
খুরশেদ আলম বলেন, এখন আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, যা হয়ে গেছে তা কীভাবে মোকাবিলা করব। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, ঢাকায় রাষ্ট্রদূত যারা রয়েছেন, তারা পুলিশ পাচ্ছেন না। অনেক রাষ্ট্রদূত ফোন করেছেন, তাদের পুলিশ নেই, তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে ভয়াবহ যে কাজটি হয়েছে তা হচ্ছে, কূটনীতিকপাড়ায় যে অগ্নিকাণ্ডগুলো হয়েছে, যেসব বাড়িঘর ও অফিস পোড়ানো হয়েছে। সেগুলোতে কূটনীতিকরা বেশি আতঙ্কিত হয়েছেন। এর ব্যাখ্যা আমরা কী দেব, কীভাবে মোকাবিলা করব– প্রশ্ন রাখেন তিনি।
সভার শুরুতে মেরিটাইম অনুবিভাগের সচিব বলেন, পররাষ্ট্র সচিব একটি বিশেষ কাজে বাইরে থাকার কারণে আমাকে কয়েকটা কথা বলার জন্য বলা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ হচ্ছে বিদেশি মিশনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা। সেই সঙ্গে বহির্বিশ্বে আমাদের অবস্থান তুলে ধরা। এ কাজটি সব সময় করে থাকি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবেগপূর্ণ স্ট্যাটাস দেওয়া থেকে বিরত থাকার বিষয়ে সতর্ক করে তিনি বলেন, আমাদের পেশাদারি কাজটি করতে গিয়ে এমন কোনো কাজ বা এমন কোনো স্ট্যাটাস আমরা যেন না দিই। সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী হিসেবে আমাদের যা করণীয়, তার বাইরে অন্যরা এটিকে দেখতে পারে। এটি যেন না হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, টানা সাড়ে ১৫ বছর একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকার কারণে দীর্ঘদিন ধরে বিগত সরকারের একটি ব্যাখ্যা বহির্বিশ্বে দিয়ে এসেছেন কর্মকর্তারা। এখন হঠাৎ ক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে এখানকার অধিকাংশ কর্মকর্তা পরিচিত নন। ফলে এ সময়ে তারা কী ব্যাখ্যা দেবেন, তা তারা জানেন না। ফলে কী আচরণ করতে হবে, সভায় তা নিয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা দেওয়া হয়।
মো. খুরশেদ আলম বলেন, দেশে একটা বড় ধরনের ঘটনা ঘটে গেছে, এ বিষয়ে আপনারা অবগত রয়েছেন। যেটা বলতে চাচ্ছি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের, আমাদের সরকারের কার্যাবলি, বাংলাদেশে যে বিদেশি মিশনগুলো রয়েছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা। সেই সঙ্গে বহি:বিশ্বে আমাদের অবস্থান তুলে ধরা, এ কাজটি সব সময়ে করে থাকি। গতকাল পর্যন্ত যে সরকার দায়িত্বে ছিল, আমরা তাদের অনুযায়ী কাজ করেছি। আবার নতুন সরকার গঠিত হচ্ছে , নতুন অন্তবর্তিকালিন সরকার হয়ে যাবে, নতুন কেউ আসবেন, উনারা আমাদের যেভাবে বলবেন, আমরা সেভাবে করবো। এ কাজটি করতে গিয়ে আমরা একটা পেশাদারিত্ব বজায় রাখি।
এ সময় তিনি কারও সঙ্গে কথা বার্তায়, ব্যবহারে বা স্ট্যাটাসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সতর্ক হতে বলেছেন।
মো. খুরশেদ আলম বলেন, আপনাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, আপনারা কেউই এককভাবে , এটি ভাবার কোনো সুযোগই নাই, যে না আমিতো এটা আগেও লিখতে পারতাম। আগে লিখতে পারতেন লিখতেন। সমস্যা হচ্ছে আপনি যদি কূটনৈতিক পেশা পছন্দ না করেন, আপনার কাছে (পেশা পরিবর্তনের) সযোগ রয়েছে। কিন্তু চাকরি করলে এর নিয়ম মেনে করতে হবে। এ সময়ে কারও কোনো প্রশ্ন রয়েছে কি না বা কোনো বিষয়ে পরিষ্কার হতে চায় কি না জানতে চান সাবেক এ রিয়ার অ্যাডমিরাল।
তিনি আরও বলেন, আপনি বলতে পারেন, উনিতো সাত দিন আগে এ কথা বলেছেন, আজকে কেন এ কথা বলছেন, আপনি মানুষ হিসেবে এ প্রশ্ন তুলতে পারেন, সাত দিন আগে আমরা কি বলেছি, আর ৭ দিন পর আমরা কি বলছি। কিন্তু এটা বললে কি হবে, আমাদের কাজের অংশ হিসেবে, আমরা এর ব্যাখ্যা করতে পারব না। যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তার বিষয়ে প্রচার করবো। আমাদের অন্য ১০টা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তুলনা করার সুযোগ নেই। কারণ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খুবই সেনসিটিভ মন্ত্রণালয়।
আপনার মতামত লিখুন :