দেবদুলাল মুন্না: একসময় খান উপাধি হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের কিছু মানুষজন ব্যবহার করতো। এমনকি বুলগেরিয়ানরাও ব্যবহার করতো। ব্রিটিশরা মুসলিমদের ‘খান’ ও হিন্দুদের ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি দেয় বলে বহুল জনপ্রিয় ধারণা আছে। খান বা খাঁ একটি উপাধি যা বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। উৎপত্তি মঙ্গোলীয় ও তুর্কি ভাষায়। এর অর্থ সেনানায়ক, নেতা বা শাসক। খান বলতে গোত্রপতিও বোঝায়। মুসলমান আমলে প্রদত্ত বেশকিছু সম্ভ্রান্ত উপাধি পদবি হিসাবে পুরুষানুক্রমে অনুসৃত হয়েছে এবং এখনও হয়ে চলেছে। ভারতে এখনও অনেক হিন্দু বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশে ‘খান’ ব্যবহার করেন। মনে করা হয় হিন্দুদের মধ্যে সুলতানি আমলে মালাধর বসুকে ভগবতের বাংলা অনুবাদ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে কবিকে তিনি গুণরাজ খান উপাধি দেন। এই থেকে শুরু হিন্দুদের ‘খান’ উপাধি গ্রহণ। কিন্তু এই তথ্যও সঠিক নয়। প্রাচীন ভারতে পদবির এক বড়োসড়ো অংশ এসেছে উপাধিনাম থেকে। মধ্য যুগে রাজা মহারাজারা সম্ভ্রম-উদ্রেককারী নানা উপাধি গ্রহণ করতেন, কৃতী প্রজাদের উপাধি প্রদানও করতেন। চক্রবর্তী এমনই এক উপাধি, যেটার অর্থ ছিলো সার্বভৌম নৃপতি। পরে এই উপাধি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদেরও দেওয়া হতো তাঁদের অধিগত বিদ্যার স্বীকৃতি হিসাবে এবং কালক্রমে তা তাঁদের পদবি হয়ে উঠেছে। বিদ্বানসূচক অন্যান্য উপাধিদের মধ্যে ছিলো কাব্যতীর্থ স্মৃতিতীর্থ পঞ্চতীর্থ স্মৃতিতীর্থজ্যোতির্ভূষণ সরস্বতী ন্যায়রত্ন তর্কালংকার বিদ্যাসাগর ইত্যাদি।
যেমন, অশোকের আমলে কলিঙ্গের এক সমরবিদের নাম ছিলো পরিতোষ খান। তিনি হিন্দু ছিলেন। ইতিহাসবিদ অমলেশ ত্রিপাঠির প্রপিতামহের নাম ছিলো সুনয়ন খান। ফলে চেঙ্গিস খানের আগমনের পর খান উপাধি চালু হয় এই ধারণা অর্ধেক সত্য। জনপ্রিয় হয় ও পরে হিন্দু সম্প্রদায় খান উপাধি ত্যাগ করেন। ইন্টারেস্টিং বিষয় অনেক মুসলমানও একসময় ‘পুরকায়স্থ’ উপাধি ব্যবহার করতেন। কায়েত মানে এলাকা/জমি। পুরা মানে বিরাট এলাকা বা জমি। সেই অর্থে ‘পুরাকায়স্থ’ উপাধি ব্যবহার হতো জমিদার হিসেবে। বাংলাদেশে ড. আব্দুর রশীদ পুরকায়স্থের নাম কয়জন জানে? তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রিলিয়ান্ট শিক্ষক ছিলেন। নাম লিখে গুগলে খোঁজ করলেই পাবেন। যাক, মুসলমানরাও একসময় ‘পুরকায়স্থ’ উপাধি পরিহার করে। যেন ‘খান’ আমাদের ‘পুরকায়স্থ’ তোমাদের বা ‘পুরকায়স্থ’ আমাদের ‘খান তোমাদের। এইখানের রাজনীতিও যে ধর্মকেন্দ্রিক সেটা না বোঝার কথা নয়। লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক