শিশির ভট্টাচার্য্য: [১] এতো মিথ্যা কীভাবে বলা যায়? আমি কানাডার মন্ট্রিয়লের এক স্কুলের সপ্তম শ্রেণির অঙ্ক বই দেখলাম। বাংলাদেশের সপ্তম শ্রেণির অঙ্ক বইতে কানাডার সপ্তম শ্রেণির অঙ্ক বইয়ের তুলনায় অনেক বেশি বিষয় পড়ানো হয়। বিজ্ঞান শিক্ষার দিক থেকেও মন্ট্রিয়লের বইগুলো বাংলাদেশের তুলনায় এগিয়ে নেই। বাংলাদেশে নবম-দশম শ্রেণির সাধারণ বিজ্ঞান বইতে যতোটা বিজ্ঞান পড়ানো হচ্ছে, মন্ট্রিয়লে নবম-দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান নিয়ে যারা পড়তে চায়, তাদেরও ততোটা বিজ্ঞান পড়ানো হচ্ছে না। আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে, বাংলাদেশে সব শিক্ষার্থীকে এতো বেশি বিজ্ঞান পড়ানো সম্ভব হবে কি?
নবম-দশম শ্রেণির বইটা যতো পড়ছি, ততোই মনে হচ্ছে, যথেষ্ট বিজ্ঞান পড়ানো হচ্ছে না বলে যারা অভিযোগ করছেন, তারা বিজ্ঞান বইটা পড়ে অভিযোগ করছেন না, স্রেফ অভিযোগ করার জন্যই অভিযোগ করছেন। আপনারা বিজ্ঞান বইটা পড়ুন, বিদেশের বইয়ের সঙ্গে তুলনা করুন এবং তারপর কথা বলুন। এতো মিথ্যা কীভাবে বলা যায়? নবম-দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ের সমস্যা কম বিজ্ঞান পড়ানো নয়, বরং বেশি বিজ্ঞান পড়ানো। বিজ্ঞানের এতো কঠিন এবং সমৃদ্ধ সিলেবাসের মুখোমুখি হয়ে ছেলেমেয়েরা ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ বলে স্কুল না পালায়, ড্রপআউট না বেড়ে যায় সিলেবাসের কারণে, সেই ভয় হচ্ছে আমার।
[২] এই যে বলছি ‘বেশি’ পড়ানো হচ্ছে, কার জন্য বেশি? যে ৫% বিজ্ঞান বিভাগ বাছাই করতো, তাদের জন্য নিশ্চয়ই বেশি নয়। যে ৯৫% বিজ্ঞান নিতো না, তাদের জন্য কি বেশি? অবশ্যই বেশি। কোন নিরিখে আমি সেটা বলছি? প্রথম নিরিখতো বললামই, আমার নিজের অধীত বিজ্ঞান। দ্বিতীয় নিরিখ কাণ্ডজ্ঞান। আগে বিজ্ঞান না নেওয়া ছাত্রদের জন্য যদি একটা সাধারণ বিজ্ঞান থেকে থাকে, তাতে যে পরিমাণ বিজ্ঞান ছিলো, এখনকার বিজ্ঞান বইয়ে তার চেয়ে বেশি থাকার কথা। আছে কি নেই, তা জানতে ২০২৩ সালের নবম শ্রেণীর সাধারণ বিজ্ঞান বইয়ের সঙ্গে ২০২৪ সালের বিজ্ঞান বইয়ের পাঠ্যসূচীর তুলনা করলেই হয়। ২০২৩ সালের সাধারণ বিজ্ঞান বইয়ের পাঠ্যসূচীতে ছিলো: ১ম অধ্যায়: উন্নততর জীবনধারা, ২য় অধ্যায়: জীবনের জন্য পানি, ৩য় অধ্যায়: হৃদযন্ত্রের যত কথা, ৪র্থ অধ্যায়: নবজীবনের সূচনা, ৫ম অধ্যায়: দেখতে হলে আলো চাই, ৬ষ্ঠ অধ্যায়: পলিমার, ৭ম অধ্যায়: অম্ল ক্ষারক ও লবণের ব্যবহার, ৮ম অধ্যায়: আমাদের সম্পদ, ৯ম অধ্যায়: দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস, ১০ম অধ্যায়: এসো বলকে জানি, ১১শ অধ্যয়: জীবপ্রযুক্তি, ১২শ অধ্যায় প্রাত্যহিক জীবনে তড়িৎ, ১৩শ অধ্যায়: সবাই কাছাকাছি, ১৪শ অধ্যায়: জীবন বাঁচাতে বিজ্ঞান।
এবার নিজেই তুলনা করে দেখুন, বর্তমানে নবম শ্রেণীতে এর চেয়ে বেশি পড়ানো হচ্ছে কিনা। সাধারণ বিজ্ঞানের বই ছিলো অনেকটাই জীবনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োগভিত্তিক। এখনকার বিজ্ঞান বইতে তত্ত্বের পরিমাণ বেশি। এই বই যারা পড়বে, তারা অবশ্যই বিজ্ঞান আমাদের প্রজন্মের কলা ও বাণিজ্যের শিক্ষার্থীদের তুলনায়তো বটেই, ২০২৩ সালের ‘সাধারণ বিজ্ঞান’ পড়ুয়াদের চেয়েও বেশি বিজ্ঞান পড়বে। তারা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের তুলনায় যতোটা কম পড়ছে বলে দাবি করা হচ্ছে, সেই ঘাটতি উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পূরণ না করতে পারার কোনো কারণ নেই। বিদেশে এই ধরনের ঘাটতি পূরণ করার জন্য প্রচুর রিমিডিয়াল কোর্স থাকে। এছাড়া প্রাইভেট টিউটর আর অন্তর্জালের কোর্সতো আছেই এবং শিক্ষার্থী হিসেবেও তারা যেহেতু ভালো, সেহেতু যে কোনো ঘাটতিই তাদের পূরণ করতে পারার কথা। লেখক : ভাষাবিজ্ঞানী। ফেসবুক থেকে