প্রবীর বিকাশ সরকার: সততা এবং স্বচ্ছতার প্রকাশ গণতান্ত্রিক ও আধ্যাত্মিক মানসিকতার প্রধান শর্ত। যেকোনো পেশা, বৃত্তি, চর্চার ক্ষেত্রে এ দুটি রীতি না মানার অর্থ স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্ট পথ অবলম্বন। সভ্য কোনো সমাজেই তা গ্রহণযোগ্য নয়। কেন নয়? কারণ জাতি, গোত্র, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় এবং সমাজকে ক্রমিক উত্তরণের বিপরীতে ঠেলে দেওয়া হয়। ডাস্টবিনে পরিণত হয় একটি দেশ বা জাতি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতবর্ষকে ডাস্টবিনে পরিণত করেছিল। সেই ডাস্টবিন থেকে বেরিয়ে মুক্তিলাভের জন্যই ঘটেছিল একাধিক বিপ্লব। আর বিপ্লব অগ্নিগিরির জন্ম দিয়েছিল গোটা ভারত সাম্রাজ্যের দুটি অঞ্চলে বঙ্গ এবং পাঞ্জাবে। বিপ্লবের মূল কারণ ছিল উচ্চশিক্ষার সুফল। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় সেইসব বিপ্লবের বিপ্লবীরা ছিলেন অধিকাংশ সুশিক্ষিত। ফলে ঘরেবাইরে তাঁরা সাধারণ মানুষের আনুগত্য ও সহযোগিতা পেয়েছিলেন। যেকোনো বিপ্লবে বা মহাপরিবর্তনের ক্ষেত্রে জরুরি সুশিক্ষিত নেতৃত্ব। এর বিকল্প নেই।
১৯ শতকের শেষার্ধে শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদ জাপানকেও ডাস্টবিনে পরিণত করতে উঠেপড়ে লেগেছিল। কিন্তু পারেনি সুশিক্ষিত কতিপয় তরুণ রাজনীতিবিদের কারণে। তখন জাপানে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, কিন্তু এদোযুগবিখ্যাত শিক্ষাগুরু ছিলেন একাধিক, যাঁরা দেশ-বিদেশের জ্ঞানবিজ্ঞান সম্পর্কে অবগত ছিলেন। সেযাত্রা কতিপয় সুশিক্ষিত তরুণ মহাবিপ্লব ঘটিয়ে জাপানে আধুনিকতার পত্তন করেন এবং রক্ষা করেন স্বদেশকে। আর কেন তাঁরা পারলেন তার প্রধান কারণ ছিল সততা এবং স্বচ্ছতা। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর বিপ্লবী, যোদ্ধা এবং সমাজ সংস্কারকরা সুশিক্ষিত ছিলেন, না হয় স্বশিক্ষিত ছিলেন। তাঁদের সততা ও স্বচ্ছতা ছিল ঈর্ষণীয়।
মেইজি যুগে (১৮৬৮-১৯১২) আধুনিকতা ও সার্বিক উন্নয়নের চাবিকাঠি ছিল শিক্ষা, সততা ও স্বচ্ছতা। আজও জাপানে এর বিকল্প আর কিছু নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন সুশিক্ষিতরাই। কেন সুশিক্ষা দরকার? নিজের সুপ্ত শক্তির জাগরণ এবং যুগের পরিবর্তনের অর্থকে অনুধাবন করত তাৎক্ষণিক ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও তৎপরতা পরিচালনা করার জন্য সুশিক্ষার বিকল্প নেই। সব বিপ্লব এবং মহাপরিবর্তনের মূলে রাজনীতি এবং অর্থ বিদ্যমান। এদুটি ছাড়া উন্নয়নও সম্ভব নয়। কাজেই এই দুটি বিষয়ে জ্ঞানার্জনের জন্যই উচ্চশিক্ষা অপরিহার্য।
রাজনীতির ক্ষেত্রে সততা ও স্বচ্ছতা ছাড়া সাফল্য সম্ভব নয়। কিন্তু সেইপথে না গিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা, মানুষকে অহেতুক হয়রানি, বাজার নিয়ন্ত্রণহীনতা, অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত সন্ত্রাসী ও ঠিকাদারকে ‘রাজনৈতিক আশ্রয় ও প্রশ্রয়দান’ সাধারণ মানুষের আগ্রহকে বানচাল করে দেয়ার সামিল। টাকা ক্ষমতা বা মেধা তৈরি করে না, মেধা টাকা ও ক্ষমতার উৎস। আর সেইই মেধাবী যার শিক্ষা, সততা ও স্বচ্ছতা আছে। সময় তাকেই মূল্যায়ন করে। বৈতরণী তার দ্বারাই পার হওয়া সম্ভব। রাজনীতি ও নির্বাচন সুশিক্ষা, সততা ও স্বচ্ছতার লড়াইক্ষেত্র। সুতরাং নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে প্রথমেই প্রকাশ করা জরুরি শিক্ষাগত যোগ্যতা, সততার উদাহরণ এবং আর্থিক স্বচ্ছতার উৎস--যা দিয়ে সাধারণ ভোটারদের সমর্থন জয় করে নেয়া সহজ হবে। অপ্রকাশিত সত্তা জনগণ তথা মানুষকে প্রতারণার নামান্তর। লেখক ও গবেষক
আপনার মতামত লিখুন :