ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল: আমাদের শরীরে আয়রনের মাত্রা অনেক সময় অতিরিক্ত বেড়ে যেতে পারে। আয়রনের মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে যায় দুটি কারণেÑ একটি হলো আমাদের শরীরে জেনেটিক পরিবর্তনের কারণে এটি জন্মগতভাবেই সাধারণত হয়ে থাকে। একে হিমোক্রোমাটোসিস বলে। অন্যটি হলো থ্যালাসেমিয়া রোগীরা যখন বারবার রক্ত নেয়, তখন শরীরে আয়রনের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। থ্যালাসেমিয়া ছাড়াও এপ্লাস্টিক এনিমিয়া, এমডিএস-এর মতো রোগেও নিয়মিত রক্ত নিতে হয়। সেসব রোগেও ফেরিটিন বেড়ে যেতে পারে।
ইদানীং আরেকটি কারণে আয়রনের মাত্রা বেড়ে যেতে দেখা যায়, অনেকসময় অহেতুক রোগীদের আয়রন ইনজেকশন দেওয়া হয়, হয়তো তার রক্তস্বল্পতা রয়েছে। কিন্তু তার রোগটি ঠিকমতো শনাক্ত না করে তাকে আয়রন ইনজেকশন দিয়ে দেয় রক্ত বাড়ানোর জন্য। তখনই শরীরে আয়রনের মাত্রা বেড়ে যায়। অতিরিক্ত আয়রনগুলো আমাদের বিভিন্ন অর্গানে জমা হতে থাকে। বিশেষ করে আমাদের হরমোন গ্রন্থিতে এই আয়রনগুলো জমা হতে থাকে। হরমোন গ্রন্থিতে আয়রন জমা হলে হরমোনের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। যেমন আমাদের যে থাইরয়েড গ¬্যান্ড আছে, সেটার কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে গিয়ে রোগীর হাইপো থাইরয়েড হয়ে যেতে পারে। পেনক্রিয়াসে জমা হয়ে রোগীর ডায়াবেটিস হয়ে যেতে পারে, এটিকে আমরা বলি ব্রোঞ্জ ডায়াবেটিস। এই ডায়াবেটিস হলে ইনসুলিন ছাড়া রোগীদের ভালো রাখা সম্ভব নয়।
এছাড়া আমাদের যেসকল প্রজনন গ্রন্থিগুলো আছে সেগুলোতেও আয়রন জমা হয়ে প্রজনন গ্রন্থিগুলো নষ্ট হতে পারে এবং প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হতে পারে। অতিরিক্ত আয়রন এ কারণেই আমাদের জন্য ক্ষতিকর এবং এটি আমাদের জন্য ভয়ের কারণ। থ্যালাসেমিয়া রোগীরা থ্যালাসেমিয়া রোগের কারণে যতটা না ভুগে, তার চেয়ে বেশি ভুগে থাকে তার আয়রনজণিত বিভিন্ন জটিলতার কারণে। অতিরিক্ত আয়রন আমাদের লিভার ও হার্টের কার্যক্ষমতাও নষ্ট করে দিতে পারে এবং সেটি খুবই জটিল একটি পরিস্থিতি। যখন আমাদের হার্ট ঠিকমতো কাজ করে না তখন আমাদের হার্ট ফেইলিউর হয়ে যেতে পারে এবং লিভারে অতিরিক্ত আয়রন জমে লিভার ফেইলিউর এবং সিরোসিস হতে পারে। অতিরিক্ত আয়রন আমাদের শরীরে জমলে আমাদের সতর্ক হতে হবে। আয়রন চিলেশনের জন্য কিছু ওষুধ আছে সেগুলো ব্যবহার করতে হবে অনেকসময় আমরা ইনজেকশন দিয়ে থাকি। আবার মুখের ওষুধও দিই। মুখে খাওয়ার ওষুধ খেয়েই রোগী অনেক সময় ভালো হতে পারে। অহেতুক আয়রন ইনজেকশন বা আয়রনের মাত্রা না দেখে আয়রন ইনজেকশন দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। কারণ কখনো কখনো এটি অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে।
আমাদের শরীরে আয়রন মূলত সংরক্ষণ থাকে ফেরিটিন আকারে এবং আমরা সিরাম ফেরিটিন লেভেল দেখে আয়রনের মাত্রাটা বুঝে থাকি। আমাদের শরীরে সাধারণত ২৬ থেকে ৪০০ এমএল মাত্রায় আয়রন থাকে। যদি ৫০০’র উপরে যায়, তাহলে আমরা বুঝে থাকি আয়রন বেড়ে যাচ্ছে এবং ১ হাজারের উপরে গেলে আমরা তাকে চিকিৎসা দিয়ে থাকি। রক্তে আয়রনের মাত্রা বেড়ে গেলে ক্ষুধামন্দা বা খাওয়ার অরুচি, বমিভাব, জ্বর জ্বর ভাব, দুর্বলতা এসব দেখা দেয়। অনেক সময় অতিরিক্ত আয়রনের ফলে আমাদের ত্বকের রং বদলে যায় এবং বাদামী রং ধারণ করে।
পরিচিতি : রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সিটিউট ও হাসপাতাল। শ্রুতিলিখন : জান্নাতুল ফেরদৌস