শেখ আলিমুজ্জামান: স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অন্যতম কারিগর সিরাজুল আলম খান মারা গেলেন। তাঁর মৃত্যু উপলক্ষে প্রিন্ট এবং স্যোশাল মিডিয়াতে অনেক স্মৃতিচারণ ও মূল্যায়ন হচ্ছে। অনেকে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ নিয়ে তার প্রতি বিষোদগার করেছেন, অথচ সমাজতন্ত্রেরর আগে বৈজ্ঞানিক শব্দটি কোন প্রেক্ষাপটে যুক্ত হয়েছিলো, সেটি বোঝেন বলে মনে হয়নি। মার্ক্সের বস্তুবাদি দর্শনের মূল কথা, বস্তুই সব। মানুষ প্রকৃত অর্থে বস্তু। আত্মার আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই, ঈশ্বর বলে কিছু নেই। সমাজের গঠন ও তার রূপান্তর বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বস্তুবাদের দ্বান্দ্বিক প্রয়োগ পদ্ধতি হচ্ছে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। অর্থাৎ মার্ক্সের বস্তুবাদ নাস্তিকতা প্রসূত একটি দর্শন। এই বস্তুবাদি দর্শন ভিত্তি করেই ১৮৪৭ সালে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ইস্তেহারে সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারণা প্রকাশ করেন।
বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ব্যাখ্যা করতে কার্ল মার্ক্স সমাজতন্ত্রকে মোটা দাগে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। একটি নিজের প্রবর্তিত দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদভিত্তিক বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র অন্যটি তাঁর সময়ের আগে যুগেযুগে প্রবর্তিত নৈতিক ন্যায়ভিত্তিক সকল সমাজতান্ত্রিক ধারণাসমূহ, যেগুলোকে তিনি এককথায় নাম দেন ইউটোপিয় বা কাল্পনিক সমাজতন্ত্র। প্রাচীনকালের গ্রিক দার্শনিক প্লেটো, এরিস্টটলের সমাজতান্ত্রিক ধারণা থেকে শুরু করে ইসলামী সমাজতন্ত্র, পরবর্তী সময়ে ফরাসি বিপ্লবের সমজাতন্ত্রÑ সবকিছুই কার্ল মার্ক্স কাল্পনিক সমাজতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করে নাকচ করে দেন।
বাংলাদেশের সব মার্ক্সবাদিই মূলত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের অনুসারী। তবে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ প্রচার করলেও তাঁরা বৈজ্ঞানিক শব্দটি সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। কারণ বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মুসলিম জনগোষ্ঠি সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের সাথে নাস্তিকতার সম্পৃক্ততা গ্রহণযোগ্য মনে করে না। এমন কি কমিউনিস্টদের একটা বড় অংশ সমাজতন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হলেও তার বৈজ্ঞানিক অর্থাৎ নাস্তিক আইডেনটিটি ধারণ করেনি। সিরাজুল আলম খান জাসদের তাত্ত্বিক গুরু হিসাবে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ কথাটি সামনে আনলেও সেটা যে মূলত কার্ল মার্ক্সের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র সেটা পরিষ্কার করেননি। তবে দায়ভার শধু তাঁর নয়। বাংলাদেশের সংবিধানে চারটি মৌলিক নীতির মধ্যে সমাজতন্ত্র অন্যতম। সেই সমাজতন্ত্র বৈজ্ঞানিক নাকি ইউটোপিয় বা কাল্পনিক, তাও কিন্তু পরিষ্কার নয়। কারণ সম্ভবত ওই নাস্তিকতার প্রসঙ্গ। বরং সমাজতন্ত্রের কথাবার্তা বেশি বললে সামনে চলে আসতে পারে জাকাতভিত্তিক অর্থনৈতিক সাম্যবাদ বা ইসলামী সমাজতন্ত্রের মতবাদ। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী সারা জীবন সমাজতন্ত্রের আদর্শ প্রচার করলেও শেষ জীবনে বলে গেছেন ইসলামী সমাজতন্ত্রের কথা ।
তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘তাত্ত্বিক নেতা’ হিসাবে পরিচিত সিরাজুল আলম খান আজীবন নিজের তত্ত্বের প্রতি সৎ থেকে গেছেন। তাঁর লম্বা চুল আর মুখ ভর্তি দাড়ি কার্ল মার্ক্সের কথাই মনে করিয়ে দেয়। জাসদের ব্যর্থতার পর রাজনীতিতে আর সক্রিয় হননি, জীবনের শেষ ৪০ বছর কাটিয়েছেন নিভৃতে। শেষ ইচ্ছার কথা বলে গেছেন মহিউদ্দিন আহমদের লেখা ‘প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান’ বইটিতে। সেটি হলো, মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ যেন গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দ্রুত মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। কবর বা দাফন শব্দগুলো উচ্চারণ করেননি। হাসানুল হক ইনু বা রাশেদ খান মেননের মতো সারা জীবন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বুলি আউড়িয়ে, পরিশেষে ইহরাম বেধে মক্কাগামী বিমান ধরেননি। ফেসবুক থেকে