মাসুদ রানা: সমাজতন্ত্রের সাধারণ সংজ্ঞা হচ্ছে এমন একটি অর্থনৈতিক ও এর পরিপূরক সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে উৎপাদনের উপায়ের (means of production) ওপর ব্যক্তি-মালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত, যার উদ্দেশ্য ব্যক্তিগত মুনাফা নয় বরং সামাজিক প্রয়োজন মেটানো।
সামাজিক মালিকানার বিবিধ রূপ থাকতে পারে, যেমনঃ রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সাম্প্রদায়িক মালিকানা, সমবায়িক মালিকানা, কর্মী মালিকানা, ইত্যাদি।
সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব ও প্রকার বিবিধ, যাদের মধ্যে একটি হচ্ছে মার্ক্সবাদী সমাজতন্ত্র, যেটিকে মার্ক্সবাদীরা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বলে দাবী করেন। মার্ক্সবাদীদের দাবী অনুসারে, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্বরূপ হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব (dictatorship of the proletariat), যা সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বাধীন বিপ্লবে পুঁজিপতি শ্রেণীকে উৎখাত করে প্রতিষ্ঠা করতে হয়।
আমরা কার্যতঃ দেখেছি, সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বর মূর্তরূপ হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণীর দল বলে দাবীদার ও বিপ্লবে বিজয়ী রাজনৈতিক দলের একনায়কত্ব, এবং যার ব্যক্তিকৃত (personified) রূপ হচ্ছে শীর্ষনেতার কর্তৃত্ব। মার্ক্সবাদীদের মতে, শ্রেণী নিরপেক্ষ কোনো গণতন্ত্র নেই। তাদের মতে, প্রচলিত গণতন্ত্র হচ্ছে পুঁজিপতি শ্রেণীর গণতন্ত্র, যা শব্দান্তরে শ্রমজীবী শ্রেণীর ওপর পুঁজিপতি একনায়কতন্ত্র। আর, এর বিপরীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের গণতন্ত্র হচ্ছে পুঁজিপতি শ্রেণীকে ক্ষমতাচ্যুত করে দমিত রাখার উদ্দেশে সর্বহারা শ্রেণীর একানায়কতন্ত্র।
যাহোক, ঐতিহাস বলে যে মার্ক্সবাদী সমাজতন্ত্র বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতিতে কোনো-কোনো দেশে ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হলেও, তা কয়েক দশক পর ভেঙ্গে পড়ে - যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন। অবশ্য, মার্ক্সবাদীরা ধর্মবাদীদের মতোই তাদের আদর্শ বা তত্ত্বের ভুল স্বীকার করতে নারাজ। তাদের মতে, ভুল আদর্শের নয়, ভুল হচ্ছে প্রয়োগের। এর মানে কী? যে-আদর্শ ঐতিহাসিকভাবে প্রয়োগকরে টিকিয়ে রাখা যায়নি, সেটি আদর্শের ত্রুটি ছাড়া আর কী হতে পারে? এখানে আদর্শের ত্রুটি বলতে আদর্শের মধ্যে স্ববিরোধিতাও হতে পারে, আবার আদর্শের প্রয়োগযোগ্যতার ঘাটতিও হতে পারে।
আরেক ধরণের সমাজতন্ত্র আছে, যাকে সৌশ্যাল ডেমোক্র্যাসি বা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র বলা হয়, কিন্তু মার্ক্সাবাদীদের কাছে একটি একটি গালির মতো। কারণ, এ-প্রকারের সমাজতন্ত্র প্রার্থিত হয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। যাহোক, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেখানে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ব্যক্তির ইচ্ছা-নির্ভর না হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতাদের ভিত্তিতে গৃহীত হয়, সেই গণতান্ত্রিক নীতিকে শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রে আবদ্ধ না রেখে অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলেই তা সমাজতন্ত্রের সাধারণ রূপ পরিগ্রহ করে। তাই, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীরা মনে করেন যে, গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ করা ছাড়া সমাজতন্ত্র নির্মাণ করা যায় না এবং কোন ঐতিহাসিক বিশেষ পরিস্থিতিতে তা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেও তা টিকিয়ে রাখা যায় না।
আমি মনে করি মন্ত্র (theor) ও তন্ত্র (system) সবকিছুই সভ্যতার যাত্রাপথে মানুষের ঐতিহাসিক প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশে ঐতিহাসিক উৎপাদন। তাই, পুনোনো মন্ত্র-তন্ত্রের ওপর সন্দেহাতীতভাবে নির্ভর করে নতুন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার চিন্তাই এক প্রকার রক্ষণশীলতা এবং কখনও কখনও প্রতিক্রিয়াশীলতা। আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে হবে। কিন্তু নতুন ভাবনার জন্যে যে চিন্তার ও মনের জগতে একটি সবল বিপ্লবের প্রয়োজন হয়, সেটি খুবই কঠিন। কিন্তু এগিয়ে যেতে হলে, সেই কঠিন কাজটিই আমাদের করতে হবে। ০১/০৬/২০২৩। লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড