বাতেন মোহাম্মদ: আমাদের দেশে যৌথ পরিবার ভেঙে দিন দিন একক পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। এটা সম্ভবত পৃথিবীব্যাপী কমন ট্রেন্ড। যদিও এই এককত্বের নানা দিক আছে, তবে আমাদের সমাজে পারিবারিক কলহ ও বনিবনা না হওয়াটাকেই বারবার প্রধান কারণ হিসাবে সামনে নিয়ে আসা হয়। যদিও অর্থনীতির সূত্রমতে, এ ধরনের একক পরিবার বেড়ে যাওয়া আসলে একটা অর্থনৈতিক ট্রেন্ড। যেটা আসলে রাষ্ট্রীয় নীতি সহায়তার একটা আউটকাম বলা যায়। পরিবারের সংখ্যা বাড়ার সাথে অনেক গৃহস্থালী পন্যের চাহিদা বাড়ে, বাসস্থানের চাহিদা বাড়ে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ে। তাই এই ধরনের এটমাইজেশনের সাথে উদারনৈতিক নীতি (লিবারেলিজম) এর একটা প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে। তবে আজকে আমার ভাবনার বিষয় আসলে পরিবার না, সংগঠন। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, পরিবেশবাদী সংগঠন। আমি দেশে থাকতে কিছুদিন নানা পরিবেশবাদী সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু সেখানেও নানা ভাঙাগড়া দেখা যায়। পুরনো সংগঠন ভেঙে নতুন নতুন সংগঠন তৈরি হচ্ছে।
এটা ভালো কি খারাপ সেটা এক কথায় উত্তর দেওয়া যাবে না। তবে এসব সংগঠন বেড়ে যাওয়ার পেছনে নীতিগত বিরোধ থেকেও ব্যক্তিগত স্বার্থ বেশি কাজ করে কিনা এটা প্রশ্ন খুব জটিল হলেও এটাই সবাই সামনে নিয়ে আসে। বিশেষ করে পুরনো সংগঠনের নেতৃত্ব স্থানীয়রা। এই যে সংগঠনের প্লুরালিজম এটাকে অনেকে বলছে ভালো কারণ একক সংগঠনের পক্ষে কোনো ইস্যুর সবদিক সমানভাবে ট্রিট করা কঠিন, তাই একেক সংগঠন একেকদিক দেখবে। কিন্তু অনেকে বলে এটা বিরোধ বাড়িয়ে মুল কাজ থেকে ফোকাস সরিয়ে দেয়। দুটো যুক্তি এক অর্থে সঠিক। তাই ইদানিং নেটওয়ার্ক গভর্নেন্স জনপ্রিয় হচ্ছে। মানে জোট। রাজনীততে যেমন জোটবদ্ধতা, তেমনি সংগঠনের ক্ষেত্রেও জোটবদ্ধতা। যদিও সেখানে বৃহৎ সংগঠন কিংবা বড় দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় কিন্তু জোট বদ্ধতা নীতিগত বিরোধ থাকার পরেও অনেক ইস্যুতে কমন স্বার্থের ভিত্তিতে একধরনের কনসেনশাস ডেভলেপমেন্টের সুযোগ করে দেয়। আমাদের কাছে ওয়ান ফিটস অল কোনো গভর্নেন্স ম্যাকানিজম নেই। এখন হয়তো উদারনীতিবাদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে কিন্তু সেটাও যে সমাধান না, তার বড় উদাহরণ পারিবারিক কলহ, সাংগঠনিক হিংসা বিদ্বেষ বেড়ে যাওয়া। পার্টি প্লুরালিজমের কারণে রাজনৈতিক বিরোধ বেড়ে যাওয়া।
আবার এর ভালো দিক হচ্ছে একক নেতৃত্বের বদলে অনেক সংগঠনে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হওয়া। নতুন ধরনের আইডিয়া জেনারেট হওয়া। অর্থনৈতিক চাহিদা তৈরি হওয়া। তার মানে ব্যাপারটার এমবিভেলেন্ট এফেক্ট আছে। কিন্তু একটা ব্যাপারে সবাই একমতÑ অনিয়ন্ত্রিত বাজার কিংবা সামাজিক অসাম্য থাকলে উদারনৈতিক নীতি আসলে ভালো কাজ করে না। উলটো এ ধরনের নীতি অহেতুক প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল (অর্থনৈতিক, সামাজিক) কে অন্যায্যভাবে আরও বেশি মার্জিনালাইজ করে ফেলে। আর যেহেতু এটমাইজড তাই কালেকটিভ এন্টিটির যে স্ট্রেংথ সেটাও সে ব্যবহার করতে পারে না। সব মিলিয়ে এই সিস্টেমে দরিদ্র আরও দরিদ্র এবং ধনী আরও ধনী হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
একই যুক্তি পরিবার ও সংগঠনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল না হলে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার বেড়ে যাওয়াটা অর্থনৈতিক দুর্গতি ও পারিবারিক মূল্যবোধের উপর চাপ তৈরি করে এবং সম্ভবত এর শিকার যেহেতু দুর্বলরা বেশি হয়, তাই এই ক্ষেত্রে শিশু ও নারীদের উপর চাপ বেড়ে যায়। সংগঠনের ক্ষেত্রেও তাই, ছোট সংগঠনগুলো তখন বড় সংগঠনের এজেন্ডা বাস্তবায়নের হর্স ট্রেডিং এলিমেন্ট হয়ে যায়। তারা বিতর্কিত প্রোগ্রাম এইসব ছোট সংগঠনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে তাদের ঝুকির মুখে ফেলে নিজেরা ঝুঁকিহীন থাকতে চায়। তাতে ছোট সংগঠন আরও দুর্বল হয়ে পরিবেশের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোগ্রাম থেকেও নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে এমন প্রোগ্রামের প্রতি বেশি ঝুঁকে যায় যেগুলো অনেকক্ষেত্রেই পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফেসবুক থেকে