ড. মঞ্জুরে খোদা : হিরো আলম বেটে, কালো, রোগা-হ্যাংলা, বিশ্রি-অসুন্দর সেটা আমার বক্তব্য নয়। মার্কিন রাজনীতিক ও রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকনও দেখতে বিশ্রী ছিলেন। বিশ্বখ্যাত লেখক সেক্সপিয়ার রোগা ও অসুন্দর ছিলেন। আরজ আলীরও কোনো চেহারা ছিল না। তামিল ছবির অনেক নায়ক-নায়িকাদের চেহারাও খুব ভ লো নয়। নাসির উদ্দিন শাহর চেহারাও খুব আহামরি নয়। কিন্তু তারা তাদের যোগ্যতার প্রমাণ রেখে স্বস্ব ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করেছেন, সফল ও উদাহরণ হয়েছেন। আলমের গলা ভালো না, অভিনয় ভালো নয়, কণ্ঠ সুন্দর নয়, কোনো গ্লামার নেই। সে গরিব, বাপ-মার ঠিকানা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে এমন মানুষের সংখ্যা কি কম? কিন্তু সে কি এমন যোগ্যতার প্রমাণ করেছে যে তাকে সংসদ সদস্য হতে হবে বা করতে হবে? ভালো মানুষ, যোগ্য মানুষ কি নেই? একজনও নেই? তাহলে তো বলতেই হয় এ দেশ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই! তার ভবিষ্যৎ পরিষ্কার?
সে যে নাচ, গান করেছে, অভিনয় করেছে, নাটক-মুভি করেছে তা মানুষের নিম্নমানের বিনোদন-বিকৃতি ও অপসংস্কৃতি ছাড়া আর কী? তাতে হাজার হাজার লাখ লাখ হা হা রিয়াক্ট-লাইক-কমান্ট পরেছে। তাই না সেটাই কি তার যোগ্যতা? তাকে অনেকে যারা এ কারণে অপমান করেছে, অসম্মান করেছে, অপদস্ত করেছে সে কারণে লজ্জিত-অপমানিত না হয়ে আরো কয়েকগুণ উৎসাহে সেই একই কাজ করেছে, সেটাই কি তার যোগ্যতা? সে কি তার কর্মের-প্রতিভার কোনো উন্নতি ঘটাতে পেরেছে? পারেনি, সে চেষ্টাও তার ছিল না সে বোধও তার হয়তো নেই। কবি নজরুলও ভোট করেছিলেন জিততে পারেননি। কেন বলতে পারেন?
তাহলে কেন তাকে আপনারা একজন সফল মানুষ মনে করেছেন? শত অপমান-ভৎসনায় হাল ছেড়ে না দেওয়াকেই তার যোগ্যতা মনে করছেন? সে যে মানের-স্তরের কাজ করেছে তাতে কি সবার প্রশংসা করার কথা? সে অপমান বাংলাদেশের বামদল নেতাদের বা সৎ মানুষদের কম করা হয়নি, হচ্ছে না! কই সেখানে আপনাদের তো তাদের পেছনে দাঁড়তে দেখি না। সংসদের অনেকে যারা আছে তারা আরও খারাপ। তাই বলে আপনি একজন অযোগ্য, অশিক্ষিত, স্থুল-বিকৃত সংস্কৃতির একজনকে পছন্দ করবেন? সমর্থন করবেন?
বলতে পারেন হিরো আলম, চোর, ডাকাত, পাচারকারী, মাদক ব্যবসায়ী, ঋণখেলাপি নয়। কিন্তু সেটা না থাকাই একজন মানুষের যোগ্যতা হতে পারে? সেটা তো এ দেশের অধিকংশ মানুষই নয়। এদের মধ্যে অসংখ্য সৎ-যোগ্য-দেশপ্রেমিক-আদর্শবান, নীতিবান, চরিত্রবান মানুষ আছে। কি নেই? তাদের পেছনে কেন দাঁড়াচ্ছেন না? কিন্তু সেও তো জাতীয় পাটি থেকে মনোনয়ন চেয়েছিল পাইনি। সে তো আরেক পতিত রাজনীতি ও লুটেরাদের দল। নয় কি? তার মানে সে সুযোগের অভাবে চরিত্রবান। আসলে বিকৃতিতে আমাদের সুখ তৈরি হয়, আনন্দ হয়। তাতে মজা নিতে নিতে সমাজকেটাকে আরো পঁচনের দিকে নিয়ে যাই। এগুলো হচ্ছে বঞ্চনার সুখ, বিকৃতির সুখ।
জানি এগুলো যতোটা না হিরো আলমের প্রতি ভালোবাসা থেকে থেকে হচ্ছে তার অনেক অধিক চলিত পচনশীল সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি তীব্র ঘৃণা, প্রতিবাদ ও অনাস্থা থেকে। অযোগ্যদের দেখতে দেখতে আমরা যোগ্যতার মাপ, মান ও স্তর ভুলে গেছি। সমাজের সংকট নিয়ে কথা বলছি না। বিকৃতির, অসুস্থতার তুলনামুলক আলাপে সুখ অনুভব করছি। আমরা আমাদেরও পতনও দেখতে পাই না। এগুলো কি সমাজের স্বাভাবিক ঘটনা? আমাদের দেশের তথাকথিত অভিজাত গোষ্ঠীর আত্মঅহমিকা ও অহঙ্কার হিরো আলমকে এখানে নিয়ে এসেছে। মানুষ তাদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছে, বলে প্রতিবাদ করছে। সমাজের এই অভিজাতরা কি বিষয়টা বুঝতে পারছে, মানুষ তাদের অহমিকার জবাব দিচ্ছে কীভাবে?
হিরো যদি সত্যিই এমপি হতো। যদিও তার পরাজয় বিজয়ের অধিক গৌরবের। সত্যি যদি হয়েই যেতো, কোথায় থাকতেন এ সব অভিজাতরা? মানুষকে মানুষ হিসেবে তার সম্মান করতে শিখুন। যে অপমান অন্যকে করছেন তা নিজের দিকে ধেয়ে আসছে। ক্ষমতাবলয়ের দ্বারা প্রতারিত হতে হতে মানুষ বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। দুর্বল একবার ক্ষমতা গেলে তা হবে ভয়ংকর। আপনারা কেন লজ্জায়, অপমানে, ক্ষুব্ধ ও প্রতিক্রিয়ায় ভালোকে, সুস্থকে টানছেন না। বিষয়টা কি এমন যে শিক্ষিতরাই শুধু উপরে গিয়ে বেঈমানী করে, গরীবরা সেটা করবে না? বাংলাদেশে অসংখ্য মানুষ কুলি, কামলা, মুটে-মজুর থেকে কোটিপতি, শিল্পপতি হয়েছে, শীর্ষ পর্যায়ে গেছেন। কিন্তু তাদের আবার বখে যাওয়ার নজিরও আছে। কী নেই?
ভোটে তো ভালো মানুষও দাঁড়ায়, দাঁড়ায় না? তাদের পক্ষে তো আপনাদের ক্ষেপতে দেখি না? এগুলো কি মজার বিষয়? অন্যরা বিষয়টা তামাশার পরিণত করলে আপনারাও তাই করবেন? তাহলে আপনাদের সাথে তাদের পার্থক্য কোথায়? আমাদের রুচিবোধ কি এতটাই তলানিতে ঠেকেছে, আমরা কি এতটাই নেতৃত্বশূন্য হয়ে পরেছি, এতোটাই মেধাহীন দেউলিয়া হয়ে পরেছি যে, হিরো আলমই হবে আমাদের মডেল ও ভবিষ্যৎ মোটিভেশন স্পিকার? ড. মঞ্জুরে খোদা (টরিক), লেখক-গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
আপনার মতামত লিখুন :