খন্দকার মেহেদী আকরাম:What is life? জীবন কী? এই প্রশ্নটা প্রাচীনতম একটি প্রশ্ন। এর উত্তর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে। ২০২১ সালে প্রকাশিত ব্রিটিশ নোবেল বিজয়ী জেনেটিসিস্ট পল নার্স তাঁর এই বইয়ে জীবন কী তা বিভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। একটা কোষ থেকে দুটি, দুটি থেকে চারটি, চারটি থেকে আটটি এভাবে বাড়তে বাড়তে ট্রিলিয়ন কোষ নিয়ে আমাদের দেহ তৈরী। এক কোষ থেকে বহু কোষ তৈরী হয় কোষ বিভাজনের মাধ্যমে। আর এই জটিল কোষ বিভাজন ঘটে থাকে অনেকগুলো জীনের মাধ্যমে।
পল নার্স কোষ বিভাজনে জড়িত জীনগুলির নিয়ন্ত্রক বা মাস্টার জীন আবিস্কারের জন্য মেডিসিনে নোবেল প্রাইজ পান ২০০১ সালে। এই বইটিতে পল নার্স খুব সহজ করে কোষ, জীন, ইভোলিউশন এবং জীবনের বায়োকেমিস্ট্রি বোঝাতে চেস্টা করেছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে কোষের ভেতরে কেমিক্যাল রিয়েকশন নিয়ন্ত্রিত হয় জীন এবং আমাদের পারিপার্শ্বিকতা দিয়ে, কিভাবে ইনফরমেশন পরিবাহিত হয় কোষ থেকে কোষে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, আর এসব কিছু মিলিয়েই আমাদের জীবন। এই বইতে তিনি আলোচনা করেছেন কিভাবে সাড়ে তিন বিলিয়ন বছর আগে প্রথম প্রানের সৃষ্টি হয় এবং সেখান থেকে আড়াই বিলিয়ন বছর আগে উদ্ভব হয় প্রথম এক কোষী জীব। বহুকোষী প্রানীর আবির্ভাব হয় মাত্র ৬০০ মিলিয়ন বছর আগে।
পল নার্স খুব সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে বিবর্তনের মাধ্যমে নতুন নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয় এবং কেন নতুন প্রজাতি সৃষ্টিতে বিবর্তন বা ইভোলিউশন অপরিহার্য। তার বইয়ের জীন, জীবনের বায়োকেমিস্ট্রি এবং ইভোলিউশন চ্যাপ্টার তিনটি আমার কাছে সবচেয়ে ভাল লেগেছে।
এই পল নার্স, যে কিছুদিন আগেও ছিলেন ব্রিটিশ রয়েল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট এবং যার আবিস্কৃত কোষ বিভাজনের জীনকে টার্গেট করে স্তন ক্যান্সারের ওষুধ তৈরী হয়েছে, বিজ্ঞান গবেষণার সর্বোচ্চ স্বীকৃতি স্বরূপ যিনি পেয়েছেন নোবেল প্রাইজ, তিনি এক সময় কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন না। ও- লেভেল পরীক্ষায় ফ্রেন্চ ভাষা বিষয়ে ৬ বার ফেল করায় তাকে কোন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি নেয়নি।
তাই, তাঁর সহপাঠিরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল, তিনি তখন টেকনিশিয়ান হিসেবে চাকরি শুরু করলেন একটা ইনিস্টিটিউটে। সেখানে তিনি মাইক্রোবায়োলজিস্টদের গবেষণার জন্য আগার প্লেট তৈরী করতেন। বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর আগ্রহ দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রফেসর তাঁকে ডাকলেন ইন্টারভিউতে।
সকল নিয়ম উপেক্ষা করে বিষেশভাবে তাঁকে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ দেয়া হল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে ফ্রেন্চ ভাষায় তিনি ফেল করেছেন ছয় বার, তাঁকেই পরবর্তিতে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ মেরিট উপাধীতে ভূষিত করা হয়। এখানেই শেষ নায়, পল নার্স তখন বিজ্ঞানী হিসেবে বেশ খ্যাতি পেয়েছেন। আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হল। উনি ভিসার জন্য আবেদন করলেন, কিন্তু তাঁর ভিসা রিফিউজ করা হল। কারণ তাঁর নাগরিক সনদপত্রে বাবা-মায়ের নাম উল্লেখ নেই।
তিনি তখন বৃটিশ সরকারের কাছে বাবা মায়ের নামসহ পূর্ন নাগরিক সনদপত্র চাইলেন। সনদপত্র হাতে পেয়ে তিনি আকাশ থেকে পরলেন। যাদের তিনি এত দিন বাবা মা বলে জানতেন, যাদের কাছে তিনি মানুষ হয়েছেন, তাঁরা আসলে তাঁর নানা নানী। সনদপত্রে যে মায়ের নাম রয়েছে সে আসলে তাঁর বোন। সনদপত্রে তাঁর পিতার জায়গাটা খালি। পল নার্স কোন দিনও জানতে পারেনি তাঁর আসল পিতা কে। তিনি ছিলেন তাঁর বোনের অবৈধ সন্তান। আগের দিনে অবৈধ্য সন্তান জন্ম দেয়া ছিলো সামাজিকভাবে হেয়কর। আর একারনেই পল নার্সের নানা নানী তাদের মেয়ের সন্মান বাঁচাতে, মেয়ের অবৈধ বাচ্চাকে নিজেদের বাচ্চা বলে লালন পালন করেছেন সারা জীবন।
এই যে পল নার্সের গল্পটা বল্লাম, এটাও তো জীবন। ফিলোসফিক্যালি এটাও জীবনের একটা মানে। পল নার্স একবার দুখঃ করে বলেছিলেন, আমি সারা জীবন জীন নিয়ে কাজ করেছি, কিন্তু নিজের জেনেটিক্সই আমি কোনোদিন জেনে যেতে পারলাম না। বুক ওয়ার্মগণ পড়তে পারেন বইটি। লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ