আহসান হাবিব: শিল্পের প্রতিটি মাধ্যমের ভাষা ভিন্ন ভিন্ন। কবিতার ভাষা ধ্বনি, পেইন্টিংসের ভাষা রঙ, নাচের ভাষা মুদ্রা ইত্যাদি। সংগীতের ভাষা কি? সুর। লক্ষ করছি প্রতিটি মাধ্যমের ভাষা বিমূর্ত। ধ্বনিকে ধরা যায় না, কিন্তু যখন তা শব্দে রূপান্তরিত হয়, মূর্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু শব্দের সাজানোয় বিমূর্ততা থাকে। রঙ বস্তুগত কিন্তু তা কি করে হয়ে ওঠে তার আছে অধরা কম্পনাঙ্কের উপস্থিতি, যখন তা ক্যানভাসে ছড়িয়ে পড়ে পেইন্টারের আঙুল বেয়ে, তখন তা মূর্ত হয়ে ওঠে, কখনো তা বিমূর্ত হয়ে দেখা দেয়। মুদ্রাকে আমরা দেখি কিন্তু ধরতে পারি না, তবে তা বিমূর্ততা থেকে আমাদের চোখের সামনে মূর্ততা ফুটিয়ে তোলে। সংগীতের সুর এক নির্ভেজাল বিমূর্ততা নিয়ে হাজির হয়। ধ্বনি তার প্রধান অবলম্বন। তা সুর হয়ে ওঠে যখন এক স্বর থেকে আর এক স্বরকে ছুঁয়ে ধ্বনির অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ তৈরি করে। এখানে স্বরকে ছাপিয়ে আমাদের কানে যে ধ্বনি অনুরণিত হতে থাকে, সেটাই সুর। সংগীতের ভাষা যদি এই সুর হয়, তাহলে আমরা কিভাবে তাকে মূর্তায়ন করবো? অর্থাৎ কিভাবে তাকে ব্যাখ্যা করবো বিশেষত যখন তা কথাকে সঙ্গী করে লতিয়ে ওঠে?
ধরুন, এই গানটি: দিনশেষের রাঙা মুকুল জাগল চিতে। এখানে ‘দিন’ শব্দটি সা এবং কোমল রেখাবের সাহায্যে সুরে ধ্বনিত হয়েছে, এখানে দিন কথাটি কেন এই দুটি নোটকে বেছে নিল? আমরা যদি এই গানটির সময়কাল দেখি, তবে তা সন্ধ্যাকে নির্দেশ করছে। দিনের শেষে সন্ধ্যার যে প্রকৃতি এবং তার সংস্পর্শে মানুষের অনুভূতি তা দিনের অন্যান্য সময় থেকে আলাদা। আমাদের বিখ্যাত সংগীত গুরুরা এই সময়টিকে ধরতে চেয়েছেন বিশেষ স্বরের সন্নিবেশে, পূরবী তার মধ্যে একটি রাগ। এই রাগটা সন্ধ্যাকে মানব অনুভূতিতে যেভাবে ধরা দেয়, তা রূপায়ন করে বলে আমাদের মন সাঁয় দেয়। সা থেকে কোমল রেখাব ছুঁয়ে যখন তা শুদ্ধ গান্ধার স্পর্শ করছে, তখন আমাদের চিত্তে যে ভাব ফুটে উঠছে তা সমস্ত দিনের ক্লান্তিকে ছাড়িয়ে রঙিন হতে চাইছে যেন কোনো ফুলের মুকুল যা অচিরেই ফুটবে তার ছবি ভেসে উঠছে। কথাকে মনের ভাবের সহগামী করতে এই সুরের বিন্যাস যথাযথ হয়ে উঠছে। কিন্তু স্বরগুলো আলাদা কোন ভাব তৈরি করছে না। কথাকে লতিয়ে সুর তাকে যে ব্যঞ্জনা প্রদান করছে, তা তখন আমাদের শ্রুতি বেয়ে চোখের সামনে ছবি হয়ে ফুটে উঠছে।
তাহলে কথা কিংবা স্বরকে অবলম্বন করে যা তাদেরকে অবিচ্ছিন্ন একটি তারে বাঁধছে, আলাদা ভাবে যাদের কোনো ভাবার্থ নেই, কেবল তাতে প্রযুক্ত হলেই মূর্ত হচ্ছে- এই কর্মটি যার সাহায্যে হচ্ছে সেটাই সংগীতের ভাষা। আমি যখন এই গানটা কথায় পড়ছি তখন তার একটা অর্থ বা ভাব আছে, কিন্তু যখন এটা সুরের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে, তখন তার অর্থ বা ভাব অন্য স্তরে রূপান্তরিত হয়ে পড়ছে। যা তাকে রূপান্তরিত করছে সেটাই সেই সংগীতের ভাষা। তাহলে বুঝতে পারছি স্বরের বিন্যাস কথাকে যে বিমূর্ততায় বাঁধে, সেটাই সংগীতের ভাষা। কথা যদি হয় মূর্ত, সুর বিমূর্ত- এটাই সংগীত হয়ে ওঠার দ্বান্দ্বিকতা। মূর্তকে বিমূর্তায়ন এবং বিমূর্তায়ন থেকে আবার মূর্তায়ন করা। বিমূর্ত উপদান দিয়ে মূর্তকে আবার মূর্তায়ন করা সংগীতের ভাষার বৈশিষ্ট্য।
শিল্প মাধ্যমের সব ভাষা একই পদ্ধতিতে কাজ করে। ভাষার কাজ যোগাযোগ, তা সহজেই বোধগম্য কিন্তু তা যখন শিল্পের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তখন তা বোধগম্যতার সরল স্তরে থাকে না, তা পেরিয়ে চলে যেতে থাকে গভীর থেকে গভীরে, এমনকি বোধগম্যতার বাইরে। যখন তা বোধগম্যতার বাইরে চলে যায়, তখন আমাদের মন অন্য এক বোধে আক্রান্ত হয়। এটাই সেই ইন্দ্রজাল যা চিত্তকে আনন্দ রসে সিক্ত এবং আচ্ছন্ন করে রাখে। সংগীত আমাদের অবস্থিতিকে লুপ্ত করে তার এই ভাষার শক্তির গুনে। এটা সব শিল্পের জন্যই প্রযোজ্য। লেখক: ঔপন্যাসিক
আপনার মতামত লিখুন :