আমিনুল ইসলাম: দেশে গেলে নিয়ম করে আমাদের নাখালপাড়া হোসেন আলী স্কুলের সামনে চটপটি খেতে যাই। এক ভদ্রমহিলা চটপটি বিক্রি করেন ভ্যানে করে। এইবার গিয়ে দেখি স্কুলের সামনের সকল স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এই পথ দিয়ে এক্সপ্রেস হাইওয়ে হচ্ছে। বাসার মানুষকে জিজ্ঞেস করলাম, ওই মহিলা তাহলে কোথায় চটপটি বিক্রি করে এখন? রেলগেটের অন্য পাশে ছোট একটা দোকান নিয়ে বসেছেন তিনি। কাঠের বেঞ্চে বসে চটপটির অর্ডার করতে যাব, দেখি ভদ্রমহিলার পাশে মাঝবয়েস পার হয়ে যাওয়া দাড়িওয়ালা এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। দেখে খুব চেনা-চেনা লাগছিলো। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি অনেক আগে নাখালপাড়া স্কুলের সামনে চটপটি বিক্রি করতেন না? ভদ্রলোক আমার দিকে তাকালেন, এরপর বললেন, তুমি কি এই স্কুলে পড়তে? হ্যাঁ, ছোট বেলায় টিফিনের ফাঁকে আপনার দোকানে গিয়ে কতো চটপটি আর আলু (আলু সেদ্ধ, তেঁতুলের টক আর নানান রকম মশলা) খেতাম। কিন্তু আপনি এখানে?
এবার ভদ্রমহিলা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, উনি তো আমার স্বামী। ও আচ্ছা। অবাক হয়ে আবিষ্কার করেছি, এরা জামাই-বউ কি চমৎকার করে আমাকে তুমি তুমি করে কথা বলছে। খানিক বাদে উনার জামাই চলে গেলেন। আমি তখনও চটপটি খাচ্ছি। এবার ভদ্রমহিলা আমার কাছে তার গল্প বলতে শুরু করলেন। তোমার খালু কিন্তু আরেকটা বিয়ে করেছে। আমিই চটপটি বিক্রি করে সংসার চালাই। চটপটি বানানো কি আপনি উনার কাছেই শিখেছেন নাকি বিয়ের আগেও জানতেন? না, বিয়ের আগে এসব কিছুই জানতাম না। বিয়ের পর উনার কাছ থেকেই এইসব শিখেছি। এখন উনি কিছু করেন না। আমিই হাল ধরেছি। ছেলে-মেয়ে আছে আপনার? এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়েটা ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়েছে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। জামাই ঢাকাতেই থাকে। ছেলেটা স্কুলে পড়ে ক্লাস নাইনে। কিন্তু পড়াশোনা করতে চায় না। সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে থাকে। আরও নানান কথাবার্তা হয়েছে উনার সাথে। তিনি আমার সম্পর্কেও জানতে চাইলেন। হয়তো উনার স্বামীকে আমি সেই ছোট বেলা থেকে চিনি, এই থেকেই কিনা খুব আপন ভেবে জিজ্ঞেস করছিলেন। আমার কথা শুনে বললেন, তুমি তো পড়াশুনা জানা মানুষ। লেখালেখি করো।
আমাদের জন্য পারলে একটু লিখবে। আগে চটপটি বিক্রি করে শুধু সংসারই চালাইনি। মেয়েটাকে পড়াশোনা শিখিয়েছি। বিয়ে দিয়েছি। ছেলেটাকে পড়াচ্ছিলাম। শুধু এই কাজ করেই এসব করেছি। কিন্তু এখন আর হয় না। এখন বাড়িভাড়া আর খাওয়ার টাকা যোগাড় করতেই সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমার কোনো সাহায্যের দরকার নেই। কাজ জানি। যে কাজ করি, সে কাজ করেই যেন সংসারটা চালাতে পারি। আমি তো সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করি। তাহলে আমি কেন ভালো মতো সংসার চালাতে পারব না? আমি আমার চটপটিতে ১০ টাকার এক্সট্রা ফুচকা দিতে বলেছিলাম। ফিরে আসার সময় টাকা দিচ্ছি, তিনি বললেন, এক্সট্রা ১০ টাকা দিতে হবে না তোমার। এই না বললেন সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে। তাহলে আমার টাকা কেন নিবেন না? আরে ১০ টাকার জন্য কি এমন হবে। থাক। তিনি আমার কাছ থেকে টাকাটা নিলেনই না। জানতে পেরেছি পি কে হালদার নামে এক ব্যক্তি ভারতে গ্রেফতার হয়েছেন। তিনি নাকি হাজার হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গিয়ে ভারতে ৮/১০টা বিশাল বাগান বাড়ি বানিয়েছেন, ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। আমার ঠিক জানা নেই, এই হাজার হাজার কোটি টাকা মানে আসলে কত টাকা।
তবে এতোটুকু আমি বুঝিÑ এই কাজ পি কে হালাদারের পক্ষে একা কোনোভাবেই করা সম্ভব নয়। এর মানে পি কে হালদারের মতো আরও অনেকেই হয়তো আছে। এভাবেই হাজার হাজার কোটি টাকার হিসেবে করে জিডিপি বাড়ানোর হিসেব দেওয়া হয়। পি কে হালদারদের এসব টাকাকে যোগ করে এরপর চটপটি বিক্রেতা ওই ভদ্রমহিলার মতো কোটি কোটি সাধারণ মানুষের আয়ের সাথে ভাগ দিয়ে বলা হয়, জিডিপি বেড়েছে। কিন্তু চটপটি বিক্রেতাদের মতো মানুষদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। তারা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে বাড়ি ভাড়া আর খাবার টাকা যোগার করতে হিমশিম খাচ্ছে। আর পি কে হালদাররা দেশের টাকা মেরে দিয়ে ক্যানাডা-আমেরিকা আর ভারতে আলিশান বাড়ি বানাচ্ছেন। সে বাড়ি গুলোতে দুই-তিন জন গার্লফ্রেন্ড রেখে মনের আনন্দে জীবন পার করছেন। আচ্ছা, পি কে হালদার এই যে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন, এই টাকা দিয়ে চটপটি বিক্রেতা ওই ভদ্রমহিলার মতো কতোজন মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা যেতো? ধরে নিলাম হালদার মশাই তিন হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন (যদিও বলা হচ্ছে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি, এরপরও কম করেই ধরলাম)।
এই তিন হাজার কোটি টাকা দিয়ে অন্তত বাংলাদেশের ১০ লাখ মানুষের ভাগ্য একদিনেই পরিবর্তন করে ফেলা যেতো এবং দিনশেষে এই মানুষগুলোর সঙ্গে আপনি একটু হেসে কথা বলুন, তারা আপনার কাছ থেকে ওই চটপটি বিক্রেতার মতো দামটুকু পর্যন্ত নিবে না। আর পি কে হালাদারদের মতো মানুষরা কি করে জানানে? দেশের খেয়ে, দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে বলবে- এই দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আর তাদের ছেলে-মেয়েরা বলে বেড়ায়- রাস্তা-ঘাট কি অপরিষ্কার। কী নোংরা এই দেশ। এই দেশে তো ভালো করে হাঁটাও যায় না। এরপরও ভাগ্য কেবল পি কে হালদারের মতো মানুষদেরই বদলায়। আর চটপটি বিক্রেতার মতো মানুষ গুলো সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খেটে গভীর রাতে বাড়ি ফিরে বিছানায় শুয়ে ভাবেনÑ পরের দিন কাজে না গেলে তো বাড়ি ভাড়া দিতে পারবো না। সন্তানদের খাওয়াও জুটবে না। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :