শিরোনাম

প্রকাশিত : ১৩ মে, ২০২২, ০১:২৯ রাত
আপডেট : ১৩ মে, ২০২২, ০১:২৯ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

প্রসূন তালুকদার: বাংলাদেশ যে কারণে শ্রীলঙ্কা হবে না

প্রসূন তালুকদার: এ নিয়ে বিরাট প্রবন্ধ লেখা যায়, যাকে আবার অনেকে তত্ত্ব আর তথ্যের মিশেলে থিসিস বলে বাস্তবতাবিবর্জিত ট্যাগ লাগিয়ে দিতে চাইবে। তাই পয়েন্ট আকারে দিচ্ছি। যে কারও হাতে একটা স্মার্ট ফোন আর ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই সব তথ্য নিজেই যাচাই করে নিতে পারেন। পরিবেশিত তথ্যের কোনোটিই নিজের গবেষণা কিংবা মনগড়া উপাত্য নয়। বিভিন্ন গবেষক, সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদদের পরিবেশিত কলাম ও উন্মুক্ত তথ্য ভান্ডার থেকে সংগ্রহ করা। পরিবেশনের আগে নিজে সব তথ্য যাচাই করে নিয়েছি।

কেন বাংলাদেশের অবস্থান শ্রীলংকার সঙ্গে কোনো অবস্থাতেই তুলনীয় নয়? [১] বাংলাদেশ থেকে ঋণ গ্রহণকারী দেশ হচ্ছে শ্রীলংকা আর বাংলাদেশ ঋণ প্রদানকারী দেশ। বর্তমান পরিস্থিতিতেও শ্রীলংকা বাংলাদেশের কাছে দুইশত পঞ্চাশ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ চেয়ে আবেদন করছে। কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ বিনয়ের সাথে অপারগতা প্রকাশ করেছে। [২] বিগত কোভিড পিরিয়ডে শ্রীলংকার রিজার্ভ দুই-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। আর বাংলাদেশ তার উল্টো। [৩] কোভিড ১৯ এর কারণে পর্যটন নির্ভর অর্থনীতি ব্যাপক মার খেয়ছে। বাংলাদেশ পর্যটননির্ভর অর্থনীতি নয় উল্টো কোভিড পিরিয়ডে চীনসহ বিভিন্ন দেশের হারানো বাজার বাংলাদেশ দখল করেছে। গার্মেন্টসসহ রপ্তানি আয়ে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। ৩ নভেম্বর ২০২১ দৈনিক প্রথম আলোর শিরোনাম ছিলো, ‘চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস: রপ্তানিতে একের পর এক রেকর্ড’, এবং মাত্র দুই দিন আগের (১০/০৫/২০২২)প্রথম আলোর শিরোনাম, ‘পণ্য রপ্তানি : পোশাকের পর শতকোটি ডলারের ঘরে তিন খাত’। এর পরেও বাংলাদেশ কোভিড মোকাবেলায় বিশ্বে পঞ্চম আর দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে।

[৪] অবকাঠামো উন্নয়নে শ্রীলংকার প্রায় পুরোটাই বহর্বিশ্ব থেকে ঋণ নিয়ে করা, কিন্তু পদ্মা সেতুসহ বহু মেগা প্রজেক্ট বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে করা। রাজধানীর কাছে শ্রীলংকা দেড় বিলিয়ন ডলারের ‘কলম্বো পোর্ট সিটি’ নামে নতুন এক শহর গড়ে তুলেছে যার অর্থনৈতিক ভূমিকা খুব বেশি নয়। কিন্তু বাংলাদেশ বিদেশি অর্থায়নে এমন বিলাসী প্রজেক্ট খুব বেশি করেনি। একমাত্র যমুনা সেতুর (বঙ্গবন্ধু সেতু) কারণে উত্তরবঙ্গ একসময়ের ‘মঙ্গা’ কে জাদুঘরে পাঠিয়েছে। আজকের পদ্মা সেতুর ইমপেক্ট হবে যমুনা সেতুর চেয়ে গভীর ও সুদূরপ্রসারী। কারণ এই সেতুর সাথে বেনাপোল দিয়ে সড়ক পথে ভারতের সাথে যুক্ত হবে বাংলাদেশ। ভারত যুক্ত হবে বাংলাদেশের উপর দিয়ে তার ‘সেভেন সিস্টারের’ সাথে যাকে আমরা ট্রানজিট বলি। উত্তরবঙ্গের চেয়ে বেশি জেলা ঢাকার সাথে যুক্ত হবে। রেলবিহীন একমাত্র বিভাগ বরিশালে রেল যাবে পদ্মা সেতু দিয়ে। ভোলায় গ্যাস পাওয়া গেছে। ভোলা হচ্ছে অন্যতম শিল্প ও পর্যটন হাব।বরিশাল-ভোলাও যুক্ত হচ্ছে সড়কপথে। কুয়াকাটা ইতিমধ্যে যুক্ত হয়ে গেছে। কিছুদিন আগে এই প্রথম সন্দ্বীপে বিদ্যুৎ লাইন গেছে সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে।

[৫.] গত  পনেরো ষোল বছরে  শ্রীলংকা ডিপ সী পোর্ট, এয়ার পোর্ট, হাইওয়ে সহ অনেকগুলো মেগা প্রজেক্ট এ বিনিয়োগ করে যার প্রায় পুরোটাই চীনা ঋণে। এসব করা হয়েছে ভারতকে কোণঠাসা করতে। আজ একই ফাঁদে পড়ে পাকিস্থান ও শ্রীলংকা উভয়েরই এই করুণ দশা। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে রুষ্ট করে চীনা প্রভাব বাড়িয়ে শত্রুতা করলে আখেরে কার লাভ হয়েছে কার ক্ষতি হয়েছে একটু অতীত ঘেটে দেখা উচিত। বায়বীয় শত্রুতা নয়, দরকার যৌক্তিক সুসম্পর্ক। এদিকে কিন্তু বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর দেওয়া পররাষ্ট্রনীতি ‘সবার সাথে সু-সম্পর্ক’ মেনে দুর্দান্তভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দুটি প্রধান থিউরি ‘ব্যালেন্স অফ পাওয়ার’ ও ‘ব্যালেন্স অফ থ্রেট’ দারুণভাবে প্রয়োগ করে চলেছে। একদিকে ‘ভারত-মার্কিন’ প্রভাব অন্যদিকে ভারত-মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বী ‘চীনা’ প্রভাবকে এমনভাবে ব্যালেন্স করছে যা ইতিহাসে বাংলাদেশের কূটনীতি আগে দেখেনি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের লিডারশিপের প্রশংসা না করে উপায় নেই। ইন্দিরা গান্ধীর পর দক্ষিণ এশিয়ায় এমন নেতৃত্ব আর দেখা যায়নি।

[৬] গৃহযুদ্ধ কিংবা স্বাধিনতা যুদ্ধ যাই বলি না কেন, তামিল টাইগাররা ছিল ভারতের মদদপুষ্ট (১৯৮৭ সালের রাজীব গান্ধীর এলটিটিই বিরুদ্ধে যৌথ অভিযানের আগে)। বর্তমান রাজাপাকসে সরকার সিংহলী বৌদ্ধদের সমর্থন পেতে তামিলদের চরমভাবে দমন করেছে চীনের সহায়তায়। বিনিময়ে চীন নিয়েছে ব্যাপক অর্থনৈতিক সুবিধা। অন্যদিকে ভারত বিরোধীদলে বিনিয়োগ করেছে বছরের পর বছর। এতোদিন পর জনরোষের সুযোগ নিয়ে প্রতিশোধ নিলো ভারত। চীনও চুপ করে গেলো। এদিকে বাংলাদেশ তার কোনো বিরোধীদের সুযোগই নিতে দেয়নি ভারত কিংবা চীনের আস্থাভাজন হবার। বাংলাদেশে যে একশোটি ইকোনোমিক জোন হচ্ছে সেসবে এবং মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর, রামপাল ইন্ডিয়া বাংলাদেশ পাওয়ার প্লান্ট, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পাবনা, কর্ণফুলী টানেল, কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইন যা মায়ানমার হয়ে চীনে সংযুক্ত হবে, টেকনাফে সাবরাং এক্সক্লুসিভ ট্যুরিজম প্রজেক্ট যা থাইল্যান্ডের কোম্পানির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করছে, কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ প্রায় একশো পঁচিশটি মেগা প্রজেক্ট, সেসবে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আছে ভারত, চীন, আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান সহ বিভিন্ন দেশের। কাজেই তারা তাদের সেসব বিনিয়োগ কখনোই ঝুঁকিতে ফেলবে না।

[৭] শ্রীলংকার মতো বাংলাদেশেরও দেউলিয়া হবার সম্ভাবনার কথা খোদ আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদেই উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বক্তৃতায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধে কখনও ডিফল্টার হয়নি, হবেও না। দেশের অর্থনীতির ভিত্তি অনেক মজবুত, সরকার অত্যন্ত সতর্ক’। বাংলাদেশের যে রিজার্ভ আছে তাতে আগামী পাঁচ কিংবা সাত বছরে কোন কিস্তির খেলাপি হবার কোনো সুযোগ নেই।

[৮] দক্ষিণ এশিয়ায় বড় অর্থনীতির দেশ হচ্ছে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা। এর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে উপরে আছে একমাত্র ভারত। বাকি দুই দেশ পাকিস্থান ও শ্রীলংকার জিডিপি যোগ করলেও বাংলাদেশের সমান হয় না।

[৯] বাংলাদেশের রপ্তানি আয় পাকিস্তান ও শ্রীলংকা দুই দেশের মিলিত রপ্তানি আয়ের চেয়েও বেশি।

[১০] বাংলাদেশের বর্তমান রিজার্ভ ৪৪.৩০ বিলিয়ন ডলার যা পাকিস্তান ও শ্রীলংকার দুই দেশের রিজার্ভের যোগফলেরও দ্বিগুনের বেশি। শ্রীলংকার রিজার্ভ ১.৯ বিলিয়ন ও পাকিস্থানের রিজার্ভ ১৬.৭১ বিলিয়ন।

[১১] বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ জিডিপির ১২ শতাংশ কিন্তু শ্রীলংকার ৪৮ শতাংশ। শ্রীলংকার মাথাপিছু ঋণ ১৬৫০ ডলার যেখানে বাংলাদেশের ২৯২ ডলার।

[১২] শ্রীলংকার ঋণে সুদের হার গড়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, কিন্তু আমাদের ১ দশমিক ৪ শতাংশ মাত্র।

[১৩] শ্রীলংকার মোট জনসংখ্যা দুই কোটির কিছু বেশি ২১.৯২ মিলিয়ন যেখানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা সতেরো কোটির বেশি। আমাদের উৎপাদিত পণ্য অভ্যন্তরীণ বাজার দিয়েই চালিয়ে দেওয়া যায় যদি কোনোদিন রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়ও। [১৪] বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্যে স্ব্য়ংসম্পূর্ণ। মাছ, মাংস, সবজি উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। বিশ্বে এই তিন ক্ষেত্রেই আমরা চতুর্থ নম্বরের মধ্যে আছি।

[১৫] বর্তমান বিশ্বে দুইটি অঞ্চলকে বলা হয়, ‘বিশ্বরাজনীতির আগামী দিনের মঞ্চ’। এর একটি ‘সাউথ চায়না সী রিজিয়ন’ অন্যটি ‘রিজিয়ন অব বে অফ বেঙ্গল’। চীনের মতো মহাপরাক্রমশালী শক্তি যেভাবে ‘সাউথ চায়না সী’ কন্ট্রোল করতে পারবে আমরাও সেভাবেই পারব সেটা আশা করা বোকামি। কিন্তু আমরা ব্যালেন্স করতে পারি কৌশলে আর আমাদের বর্তমানে সরকারের কূটনীতি বেশ ভালোভাবেই সেটা করছে। জনগণের কিছু দায়িত্ব আছে। দেখতে হবে আমরা তা করছি কিনা।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আদালতে মামলায় জিতে বঙ্গপোসাগরে যে নতুন এলাকা লাভ করেছে ভারত ও মিয়ানমার থেকে সেই বিশাল (প্রায় বাংলাদেশের মোট আয়তনের সমান) ব্লু-ইকোনোমিতে যে পরিমাণ কেবল মৎস্য সম্পদ আছে বাংলাদেশের সক্ষমতা আছে তার মাত্র পাঁচ শতাংশ আহরণ করার। অন্যান্য খনিজ সম্পদের কথা বাদই দিলাম। ‘বে অফ বেঙ্গল’ এর স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ যে আকর্ষণীয় হট স্পট বিশ্ব পরাশক্তির কাছে একই কারণে তা আবার ঝুকিপূর্ণও। তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে সব সময়। 
লেখক: গল্পকার

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়