মনজুরুল হক: [১] মরুভূমির উট দীর্ঘ মরুপথ পাড়ি দেওয়ার আগে পেট ভরে পানি খেয়ে নেয়। শরীরের ভেতর নিজস্ব পদ্ধতিতে সেই পানি প্রিজাভ করে। অবলা প্রাণীটা সারা পথ খাই খাই করে না। বাংলাদেশের ঈমানদার ব্যাপারিরা (এফবিসিসিআই টু ফুটপাথ ভায়া খাতুনগঞ্জ) রোজার মাস আসলে সকল প্রকার অস্ত্রপাতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্রেতার উপর। তারপর ঈদের আগের গভীর রাত অব্দি গলা পর্যন্ত মুনাফা গেলে। তার মানে বাকি ১১ মাস গেলে না? এইখানে তারা উটের মতো ঈমানদার না। বাকি ১১ মাসও একে অপরের ‘গলা কাটে’। এ যেন এক মহাপ্লাবন! সবাই ভেসে যাচ্ছে, কেউ কাউকে টেনে তুলছে না।
[২] কাঁচাবাজারের উত্তাপ নিয়ে বলার নেই। ওখানে ‘সার্ভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ তত্ত্ব চলে। ঈদকে সামনে রেখে এমন কোনো পন্য বা সেবা নেই যার দাম কয়েকশগুণ বাড়ে না। এ এক মাৎস্যন্যায় খাওয়া-খায়ি। যে যাকে পারে খাচ্ছে। লেবু বিক্রেতা বেশি লাভ করে হাসু হাসু মুখে ঘাড় পেতে দিচ্ছে মাছের দোকানে। মাছওয়ালা রক্তমাখা টাকা গুঁজে কতল হতে যাচ্ছে মশলার দোকানে। মশলার দোকানি জবেহ হচ্ছে জুতো-স্যান্ডেলের দোকানে। জুতোর কারবারি দুই টুকরো হতে যাচ্ছে কাপড়ের দোকানে। কাপড়ওয়ালা কাবাব হতে চলেছে মহল্লার হরেকরকম চাঁদাবাজের হাতে, দোকানমালিকের হাতে। একেবারে শেষ সময়ে সবাই মিলে জিম্মি হতে যাচ্ছে পরিবহন মাফিয়াদের হাতে। এর মধ্যে খুচরো ছাল-চামড়া উঠে যাচ্ছে গার্ড, চাপরাশি, পিওন, লিফটম্যান, কুরিয়ার, মসজিদের তালিব-ই-আলীমদের হাতে।
[৩] তারপর? সারা বছরের জমানো টাকা শেষ করে, রাতভর স্টেশনে বসে টিকিট যোগাড় করে, লঞ্চের ঘুলঘুলি দিয়ে বাড়ি যাচ্ছে। ঈদ! ঈদ! ঈদ! এরপর সব দেনা-পাওনা মিটে গেলে, যার যার বাড়ি ফিরে বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরলে, প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে গেলে, একে অপরের আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগি করে নিলে, ঈদের দিন ভরপেট খেয়ে-দেয়ে ‘যাক, এবারকার ঈদটা ভালো কাটল মাশাল্লাহ’ বলে টিভি অন করতেই দেখলেন দেশের ৫ হাজারের উপর গার্মেন্ট কারখানার প্রায় অর্ধেক কারখানা শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দেয়নি। মালিকদের অগুনতি অজুহাত। ওইসব কারখানার সাড়ে ২১ লাখ শ্রমিকের অর্ধেকই ঈদে বাড়ি যেতে পারেনি। সেই কারখানার পাশের বস্তিতে ৮ ফুট বাই ৮ ফুট টিনের চালে তীব্র রোদ পড়ে ঝলসে দিচ্ছে। সেই সাথে পুড়ে যাচ্ছে তাদের এগার মাসের অপেক্ষা। লেখক ও ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট
আপনার মতামত লিখুন :