শিরোনাম

প্রকাশিত : ০৪ মে, ২০২২, ১১:৪৬ রাত
আপডেট : ০৪ মে, ২০২২, ১১:৪৬ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ড. মঞ্জুরে খোদা: ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার ৭ দশক: ছাত্ররাজনীতির সংকট ও টিকে থাকার প্রশ্ন

ড. মঞ্জুরে খোদা: ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাকে বলা হয় ঐতিহাসিক প্রয়োজনের পরিণতি। এমনটা বলার কারণ, যে প্রেক্ষাপটে এই সংগঠনের প্রসব ঘটেছিল সেটা ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশের সন্ধিক্ষন। সেই সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এর জন্ম হয়েছিলবলেই এর জন্মভাবনাকে- এই উপলব্ধিতে বিশেষায়িত করা হয়।

পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তান ছিল ব্রিটিশের কবল থেকে সদ্য স্বাধীন একটি দেশ। সেই স্বাধীনতা ও বিভক্তির দর্শন ছিল হিন্দু-মুসলমানের দ্বি-জাতি তত্ত্ব।তারমানে দেশ, সমাজ, মানুষ ও রাজনীতিকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করা হয়েছিল।

সেই বিভক্তির সুষ্ঠু কোনো রূপরেখা ছিল না। বলা হলো, হিন্দু-মুসলমান দুই জাতি, তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতিআলাদা, তাদের একসাথে থাকা সম্ভব নয়। তাই এই দুই জাতির দুই রাষ্ট্রের দরকার। তাই করা হলো। ভারত ভেঙ্গে দু’টি রাষ্ট্র করা হলেও উভয় রাষ্ট্রে হিন্দু ও মুসলমানদের রেখেই ভাগ করা হলো।ভারতের অংশেহিন্দুদের৬ কোটি মুসলমান এবং পাকিস্তানের পূর্বঅংশে মুসলমানদের সাথে দেড় কোটি হিন্দুকে রেখে দেয়া হলো।

স্বাধীনতার এই মারাত্মক ত্রুটির কথা ভারতের মুসলমানরা মুসলিম লীগ নেতা জিন্নাহ সাহেবকে বলেছিলেন।জিন্নাহ বললেন, রাজনৈতিকভাবে কোনো মুসলমান এখন মুসলমান নয়, কোনো হিন্দু আর কোন হিন্দু নয়, সকলেই পাকিস্তানি। অর্থাৎ ভারতীয় মুসলমানরা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে থাকবে। এভাবেই সেই স্বাধীনতাকে জোড়াতালি দিয়ে জায়েজ করা হলো।

দেশ ভাগের সময়ই এই আলোচনা জোড়ালো হলেও ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ব্যস্ত থাকা নেতৃত্বের সেগুলো নিয়ে ভাবার সময় ছিল না। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল শতকরা ৩২ ভাগ ৭০ বছরে পরে সে অংশ দাড়িয়েছে শতকরা ৮ ভাগ। তারমানে ৪ভাগের ৩ভাগ নাই হবে গেছে! এই অংকের মধ্যে আছে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক রূপান্তরের উত্তর।

সে জন্যই দেশ স্বাধীন হলেও বিপদ, বিদ্বেষ কমলো না। ধর্মের ভিত্তিতে দেশ-মানুষকে বিভক্ত করা হলেও সেদিন তরুণ বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকরা বুঝতে পেরেছিলেন ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা একটি বিপদজনক রাজনৈতিক দর্শণ। এখান থেকে জাতিকে বের করে আনতে হবে। একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

ধর্মের ভিত্তিতে দেশ স্বাধীন হবার পরই বাঙালিদের ভাষার উপর শাসকের প্রথম আঘাত আসে।ধর্মের কথা বলে, ধর্মের দোহাই দিয়ে ভাষার অধিকার কেড়ে নেয়ার চেষ্টা চলে। শুরু হয় ব্যাপক বিক্ষোভ-প্রতিবাদ। সদ্য স্বাধীন দেশে বাঙালিদের ভাষার স্বাধীনতা ও জাতিয় পরিচয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু করতে হয়।সেটাই ছিল বাঙালিদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার সংগ্রামের সূচনা।শাসক সেখান থেকে পিছিয়ে গেলেও থেমে থাকেনি সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে শাসন ও বিভক্তির রাজনীতি।

সেই সংগ্রামের পরিস্থিতিতেপ্রবলভাবে অনুভূত হয়েছিল একটি অসাম্প্রদায়িক সংগঠনের। মূলত সে সময় অসাম্প্রদায়িক চেতনারকোন ছাত্র সংগঠন ছিল না। সেই আকাঙ্খা ও ঐতিহাসিক প্রয়োজনের অনিবার্য পরিণতি হিসেবেই ১৯৫২ সালের ২৬ এপ্রিল ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন’র জন্ম হয়। যেটি আজ বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন নামে টিকে আছে।এই যে টিকে থাকার কথা বলছি। সেটা না বলে যদি বলতে পারতাম তা আজো সমান গৌরব-মর্যদা ও গুরুত্ব নিয়ে আছে, তাহলে ভাল লাগতো। কিন্তু সেটা হয়নি।

সময়ের প্রয়োজনে তৈরী হওয়া এই সংগঠন যদি তার আবেদন পুরণ করে-ঐতিহ্য ও গৌরব নিয়ে থাকতো সেটা আমাদের জন্য অনেক আনন্দের হতো। তা হয়নি। কারণ ছাত্র ইউনিয়ন তার সেই দায়িত্ব পালন থেকে এখনো অনেক দূরে রয়ে গেছে। সে দায় পালন করতে না পারাই তার টিকে থাকার তাগিদ। কিন্তু যেভাবে টিকে আছে, তাতে কি তার পক্ষে সে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব? সেটা একটা বড় প্রশ্ন। সংগঠন এখন অনেকটা দূর্বল, প্রভাব ও চাকচিক্যহীন। সে দায় এককভাবে তাদের দেয়া যায় না। সামগ্রিক পরিস্থিতির এমন দশা তৈরী করেছে। উপরন্তু প্রিয় এই সংগঠনকে ঘিরে ষড়যন্ত্র এখনো থেমে নেই। তাকে নানাভাবে কলঙ্কিত করার চেষ্টা চলছে।

তরুণরা এখন রাজনীতি বিমূখ, আদর্শ, মূল্যবোধ ও লক্ষহীন। মেধাবী ছাত্ররা রাজনীতিতে নেই, তারা বিদেশমূখী। তাদেরকে ক্ষমতা দখল ও রক্ষার হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ভোগবাদ, আত্মকেন্দ্রীকতা ও স্বার্থপরতা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। রাজনীতিকে দ্রুত ক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠার মন্ত্র করাহয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলছে ক্ষমতাসীনদের একচেটিয়াসন্ত্রাস, আধিপত্য। অন্যদিকে শিক্ষাক্ষেত্রে চলছে নৈরাজ্য ও নানামাত্রিক বিভাজন-বৈষম্য। সেখানে নীতি-আদর্শের সংগঠনের টিকে থাকাটা অনেক কঠিন।

আজকাল নীতি-আদর্শ-সততাকে সমাজে দূর্বলতা ছাড়া গুণবাচক কোন বিষয় মনে করা হয় না।এমনএকটি সময়ে আদর্শের কথা বলা মানে স্রোতের বিপরীতে থাকা ও উজান পথে চলা।এ সংকট শুধু ছাত্র ইউনিয়নের নয়, সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতিসহ যে কোন সুস্থ ধারার ক্ষেত্রেই এ অবস্থা বিরাজমান।

ছাত্র ইউনিয়ন চেয়েছে, একটি সর্বজনীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, সেক্যুলার, পরিকল্পিত, বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষা শেষে সবার কাজ। একটি শোষণহীন, অসাম্প্রদায়িকসমাজতান্ত্রিক সমাজ। ৭০ বছর আগে যে অঙ্গীকার নিয়ে এ সংগঠনের জন্ম হয়েছে, তা এখন মূলআলাপ, মূলধারায় নেই। বরং জাতিয় পর্যায়ে যেটুকু অর্জন ছিল তাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সমাজে ধর্মান্ধতা-সাম্প্রদায়িকতা বহুগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। জ্ঞানবিজ্ঞান, মুক্তবুদ্ধির চর্চা-বিকাশ একপ্রকার নিষিদ্ধই। ৬০-৭০ এর দশকে সমাজ যে নীতি-নৈতিকতা, ভাবাদর্শ ও মূল্যবোধ ছিল তাও আজ নেই। কিছু অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাদে সর্বত্রই আমরা পিছিয়েছি। পিছন দিকে হাটছি।

৯০ পরবর্তিতে প্রচলিত ছাত্র রাজনীতির বাইরেগণজাগরণ মঞ্চ, ভ্যাট বিরোধী, কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের মতকয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে আন্দোলনগুলো হচ্ছে তা সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারেই। এটিছাত্র আন্দোলনের একটি নতুন মাত্রা ও প্রবণতা। তাহলে ছাত্র সংগঠনগুলো কি তাদেরদায়িত্ব পালনে ব্যর্থ? নাকি ছাত্ররাজনীতির লেজুবৃত্তিক ধারার উপর ছাত্ররা আস্থা রাখতে পারছে না? এ জন্যই এই পরিবর্তন? ছাত্র রাজনীতির প্রচলিত ধারা-কাঠামো কি তার আবেদন হারিয়েছে? বর্তমান বাস্তবতায় এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

এমন পরিস্থিতিতে ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার ৭০ বছর। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে অতীত গৌরবের নিছক চর্বিতচর্বণ না করে এর সামগ্রিক মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ।সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে এই আত্মপলব্ধি নিয়ে আসা যে, কিভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় তারা তাদের কর্তব্য পালনে অগ্রসর হবে? বর্তমান বাস্তবতায় তা কতটা সম্ভব? তানিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, তবে সে ভাবনাকে উন্মুক্ত করা সমীচীন। মনে রাখা দরকার ইতিহাসনির্ভর নয়, ইতিহাস নির্মাণের রাজনীতিই সময়ের দাবী।

বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির বিভিন্ন ধারা বর্তমান। একে প্রধানত ৪টি ধারায় ভাগ করা যায়; গণতান্ত্রিক, জাতীয়তাবাদী, বাম ও ইসলামী ধারা।ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত মূলত সরকারী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর একাংশ। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউটে রাজনীতি নিষিদ্ধ। সাম্প্রদায়িক ধারার শিক্ষার্থীদের প্রায় শতভাগ বিশেষ করে কওমী মাদ্রাসার ছাত্ররা ইসলামী সংগঠনই করে। সেখানে অন্যদের কোন সুযোগ-অবস্থা নেই। ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষেও দেশে জোড়ালো জনমত বিদ্যমান।

২০১২ সালে করাব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়েরএক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতিকে সমর্থন করেন ও ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত আছেন মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ২০ শতাংশ। তারমানে বাকি ৮০ভাগ শিক্ষার্থীর সাথে ছাত্ররাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই। উল্লেখিত ৪টি ধারার মধ্যে বামধারার ছাত্র সংগঠনের অবস্থা অত্যন্ত দূর্বল। এ ধারায় বেশ কয়েকটি সংগঠন ক্রীয়াশীল।তাদের একটি জোট থাকলেও ঐক্যের কোন অবস্থা নেই। সেই বিভক্তি তাদের আরো দূর্বল করেছে।

এ কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আদর্শগত কারণে ছাত্র ইউনিয়নকে বাকি তিন ধারার শক্তিকেই মোকাবেলা করতে হবে। সেটা করতে হলে কি পরিমান শক্তি-সংগঠন দরকার সে ভাবনা গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্যই এ কথা বলেছি যে, এই টিকে থাকা অবস্থা দিয়ে কি সম্ভব সেই বিপুল লড়াই চালিয়ে যাওয়া। সেটা এখন না হলেও সেই আকাঙ্খা পরবর্তি প্রজন্মের বুকে বুনে যাওয়ার কাজটিও গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্যই বৈরী সময়ে এই টিকে থাকাটা দরকার। ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার ৭দশক(১৯৫২-২০২২) সে কারণেই তাৎপর্যপূর্ণ।

ড. মঞ্জুরে খোদা, লেখক-গবেষক, সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন।

 

 

 

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়