শিরোনাম
◈ আ.লীগ-ছাত্রলীগের নামে বাংলাদেশে কেউ রাজনীতি করতে পারবে না: নাহিদ ইসলাম (ভিডিও)  ◈ নির্বাচন কবে? নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর উপর: প্রেস সচিব (ভিডিও) ◈ দুবাইয়ে চালু হলো অভিনব রেল বাস ◈ বুকস্টলে বাগবিতন্ডা-হট্টগোলের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ◈ গাজীপুর জেলা বিএনপির সংশোধিত আংশিক আহবায়ক কমিটি গঠন ◈ সোনার দাম বেড়ে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ  ◈ সেনাপ্রধানের সঙ্গে সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূতের সৌজন্য সাক্ষাৎ, যে আলোচনা হলো ◈ সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট মজিদ খান গ্রেফতার ◈ ফেনীতে জামায়াত নেতা বহিষ্কার, নেপথ্যে যা জানা গেল ◈ সমাজবিরোধীরা কোনো ব্যক্তিকে হুমকি দিলে কঠোর ব্যবস্থা: পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স

প্রকাশিত : ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১২:০৮ দুপুর
আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ০২:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ! ঘর ভাঙার সংস্কৃতি

গোলাম মাওলা রনি: আমার প্রাথমিক অপরাধ ছিল- রাতের ভোটের প্রধান কারিগর সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদাকে নিয়ে একটি কলাম লেখা। নূ হুদার পঞ্চ সালের পাঁচালি শিরোনামে সহযোগী একটি জাতীয় দৈনিকে নিবন্ধ লেখার কারণে নূরুল হুদা আমার ওপর ভীষণ  খেপে যান। আমি অবশ্য সেই নিবন্ধে তার সম্পর্কে তেমন মন্দ কিছু বলিনি। বরং তিনি যে একজন ভালো মানুষ ছিলেন এবং আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় পান্ডারূপে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দলের পক্ষে তৃণমূলে গিয়ে কাজ করেছেন সেটাই উল্লেখ করেছিলাম। আমি বলেছিলাম যে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় তিনি আমার বাড়িতে মেহমান হয়েছিলেন এবং শেখ হাসিনার নির্দেশে আমার নির্বাচনে যথাসম্ভব সাহায্য-সহযোগিতার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। সুতরাং তার সঙ্গে আমার একটি পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

উল্লিখিত অবস্থায় তার কাছ থেকে ন্যায়বিচার, মানবিক আচরণ এবং সহযোগিতা পাওয়ার হক আমার ছিল। কিন্তু তিনি সেটা না করে শেখ হাসিনাকে রাতের ভোটের লোভ দেখিয়ে অথবা শেখ হাসিনার রাতের ভোটের প্রধান কারিগর অর্থাৎ চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ইতিহাসের কলঙ্কময় একটি নির্বাচন আয়োজন করার পূর্বশর্ত হিসেবে আমার নির্বাচনি এলাকায় নিজের ভাগিনার নামে একটি মনোনয়ন বাগিয়ে নেন। শুধু তা-ই নয়, পুরো নির্বাচনের সময় তিনি তার প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে আমার এবং আমার পরিবারের জীবন জাহান্নামে পরিণত করে দেন। ফলে নির্বাচন করার পরিবর্তে প্রাণে বেঁচে থাকার জন্য একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আকুতি জানানোর জন্য আমার অন্য কোনো উপায় ছিল না।

নূরুল হুদাকে বাদ দিয়ে যখন হাবিবুল আউয়ালকে শেখ হাসিনা নিয়োগ দিলেন তখন আমি নূ হুদার পঞ্চ সালের পাঁচালি নামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। নিবন্ধ পাঠ করে নূরুল হুদার মাথা সম্ভবত গরম হয়ে গিয়েছিল অক্লান্ত পরিশ্রমএবং তার ভাগিনা অর্থাৎ রাতের ভোটের তথাকথিত সংসদ সদস্যের পেটের আবর্জনা মাথায় উঠে গিয়েছিল। তারা আমার গ্রামের বাড়িটি টার্গেট করে ওটাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার যে পরিকল্পনা করেছিলেন সেখানে পটুয়াখালী জেলার তৎকালীন ডিসি কামাল আহমেদ, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল কাইয়ুম এবং গলাচিপা উপজেলার ইউএনও আশিষ কুমার যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তার সঙ্গে চেঙ্গিস-হালাকুর ধ্বংসযজ্ঞের কী মিল ছিল তা সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করলেই সম্মানিত পাঠক বুঝতে পারবেন।

২০২২ সালের ১৯ জুলাই সকালবেলা কোনো রকম পূর্বঘোষণা ছাড়াই জেলা প্রশাসন উপজেলা প্রশাসন কয়েকটি বুলডোজার নিয়ে আমার বাড়ির সামনে হাজির হয়। বাড়ি ভাঙার জন্য কয়েক শ হাতুড়ি বাহিনীকে ভাড়া করে আনা হয়। লুটপাটের জন্য আনা হয় আরও ২০-২৫ জন। ১৯৬০ সালের দখলিস্বত্ব, তিন পুরুষের বসতভিটায় নির্মিত ভবনে সংরক্ষিত বহু স্মৃতিময় আসবাব, টাকাপয়সা, সোনার গহনা, দলিলপত্র কোনো কিছু সরানোর জন্য সময় না দিয়ে যখন বুলডোজার চালানো হয় এবং একই সঙ্গে হাতুড়ি বাহিনী ও লুটেরারা তাণ্ডব শুরু করে তখন সেখানে বসবাসরত আমার ৭৫ বছর বয়সি অসুস্থ মা, ভাই, ভ্রাতৃবধূ ও দুটি শিশুকন্যা কোনোমতে প্রাণ নিয়ে দৌড়ে রাস্তায় নেমে হাজার হাজার মানুষের সামনে গগনবিদারী আহাজারি শুরু করে।

ঘটনার দিন আমি ছিলাম ঢাকায়। টেলিফোনে মায়ের কান্না শুনে আমার মাথায় বজ্রপাত শুরু হলো। আমার সাত বছর বয়সি ভাতিজি অর্ধ উন্মাদের মতো দৌড়াতে শুরু করল এবং ঘটনার আকস্মিকতায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। বাড়ির সামনে একটি ফার্মেসির দোকান চালাত আমার ছোট ভাই সরোয়ার। কোনো দিন রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায়নি। সবকিছু হারিয়ে সে-ও অঝোরে কান্না শুরু করল, আমার স্ত্রী ১৯৮৬ সালে বধূরূপে ওই বাড়িতে এসেছিল। সে-ও হাউমাউ করে কান্না করে আমাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বানিয়ে ফেলল। আমরা সাত ভাই, আমি ছাড়া অন্য কেউ আমার পরিচয়, আমার রাজনীতির মুখাপেক্ষী নয়। তারা সবাই চাকরিবাকরি, ব্যবসাবাণিজ্য করে খায় এবং কালেভদ্রে উৎসব-আয়োজনে গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে বছরে দুই-তিনবার বেড়াতে যায়। আমার রাজনীতির কারণে তাদের সম্পত্তি নষ্ট বিশেষ করে আমার বৃদ্ধ মায়ের কান্না- তাদের যারপরনাই বেদনাহত করল। সবাই আমার স্ত্রীকে ফোন করে যেভাবে আহাজারি করল তার ফলে দুনিয়া মুহূর্তের মধ্যে আমার কাছে জাহান্নামে পরিণত হলো।

আমার মাকে আমি কোনো দিন কাঁদতে দেখিনি। হাসিখুশি, সহজসরল জীবনে অভ্যস্ত মা আমাদের ভাইদেরও কোনো দিন মারধর করেননি। আব্বার সঙ্গে কোনো দিন ঝগড়া করেননি। মায়ের চরিত্রের সঙ্গে বড় সন্তান হিসেবে আমার যেসব মিল রয়েছে সেগুলোর মধ্যে সহজে ভেঙে না পড়া, কান্নাকাটি না করা এবং কারও সঙ্গে দ্বন্দ্বফ্যাসাদে না জড়ানোর অভ্যাস অস্থিমজ্জায় মিশে থাকার কারণে ২০২২ সালের ১৯ জুলাই আমি কাঁদতে পারলাম না। কিন্তু আমি যেভাবে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম, আমার বুকের মধ্যে যেভাবে হাহাকার শুরু হলো এবং হাত-পা অবশ হয়ে গেল তাতে করে মনে হলো- ইস! যদি চিৎকার করে একটু কাঁদতে পারতাম।

আমার আব্বা যথেষ্ট সচ্ছল ছিলেন। আমরাও আল্লাহর মেহেরবানিতে সবাই ভালো আছি। বাড়ির আর্থিক মূল্যের চেয়ে বহু গুণ অর্থ বহুবার ব্যবসায় লোকসান হয়েছে। রাজনীতিতে অনেক অর্থ ব্যয় করেছি। জাকাত-ফেতরা, দানখয়রাতেও আল্লাহ আমাকে অনেক সুযোগ দিয়েছেন। কাজেই বাড়ির আর্থিক মূল্য আমাদের কাউকে আহত করেনি। কিন্তু প্রকাশ্য দিবালোকে আমাদের তিন পুরুষের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি যারা গুঁড়িয়ে দিয়েছেন, তারা যদি আমাদের হৃদয়ের হাহাকার, চোখের অশ্রু এবং সামাজিক অপমান ছাড়াও হঠাৎ আশ্রয়হীনতার অসহায় অনুভব বুঝতে পারতেন তবে সারা দুনিয়ার বিনিময়েও ওই কুকর্ম করতেন না।

আমাদের একটি বসতভিটার জন্য আমরা কেঁদেছি এবং এখনো কাঁদছি। আমাদের এই কান্না কেয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে এবং রোজ হাশরে আমরা সপরিবারে আল্লাহর দরবারে নালিশ জানাব। দুনিয়াতে আমাদের আকুতি ক্ষণে ক্ষণে আমাদের আহত করে। আমাদের দৈনন্দিন সুখশান্তি ব্যাহত হয়। বাড়ির কথা স্মরণে এলে যে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে তা পৃথিবীর আলোবাতাস ভেদ করে হয়তো আল্লাহর আরশে চলে যায়। আমি জানি না, সাবেক নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদা কোথায় আছেন, কেমন আছেন। তার ভাগিনা অথবা সেই ডিসি কামালের বর্তমান হালহকিকত কী? তবে তারা যে হালতেই থাকুন না কেন, আমরা সবাই তাদের চেয়ে ভালো আছি।

আমি নিয়তিতে বিশ্বাস করা মানুষ। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ যদি নিজ হাতে প্রতিশোধ না নিয়ে মহান আল্লাহর ওপর বিচারের ভার দেন তবে দুনিয়ার ভারসাম্য প্রাকৃতিকভাবে সুসংহত থাকে। যদিও প্রতিশোধ গ্রহণের হক রয়েছে, তবু মানুষ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ না নিয়ে বিচারের ভার আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিলে আসমান থেকে তখন ফয়সালা আসে যা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের অন্তরে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় এবং তার উদারতা, আল্লাহভীতি এবং আল্লাহর প্রতি নির্ভরতার কারণে স্বয়ং আল্লাহ তাঁর মজলুম বান্দার জন্য উত্তম উকিল হিসেবে দুনিয়া ও আখিরাতে তার সফল কর্মের জিম্মাদার হয়ে যান।

উল্লিখিত বিশ্বাসের কারণে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমি প্রতিশোধপরায়ণ হইনি। আমার কর্মী-সমর্থক, আত্মীয়পরিজনকে অনুরোধ করেছি, কোনো অবস্থাতেই আমার প্রতি যারা জুলুম করেছে, তাদের বাড়িঘরে যেন সামান্য আঘাত করা না হয়। মামলা-মোকদ্দমা, হুমকিধমকির মতো কর্ম যেন আমার প্রতি অত্যাচার করা লোকজনের ওপর না হয়, তার জন্য সর্বোচ্চ ধৈর্য নিয়ে নিজেদের সংযত রেখেছি। আর এসব করার কারণে আমার অন্তরের শান্তি-নির্ভীক চলাফেরা, রিজিকে বরকত এবং পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে মানসম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধিতে কীভাবে নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।

আজকের এই দিনে আমার জীবনের একটি বিয়োগান্তক ঘটনা আপনাদের কাছে বর্ণনা করার মূল উদ্দেশ্য হলো, সারা দেশে ভাঙচুরের নামে যা হচ্ছে, তা কোনো অবস্থাতেই সমর্থনযোগ্য নয়। এসব কর্মে সমস্যা বাড়বে। শান্তি বিঘ্নিত হবে। সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে এবং হানাহানি-মারামারি, বাড়িতে বাড়িতে গৃহযুদ্ধে রূপ নেবে। যারা ভাঙচুরের উল্লাস নৃত্য করছেন তাদের পরিণতিও অতীতে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটানো দুর্বৃত্তদের মতো হবে। প্রতিটি ভাঙচুরের পেছনে যেমন জিঘাংসা, প্রতিশোধপরায়ণতা, লুটপাট, ডাকাতি, দখলবাজি এবং লোভলালসা থাকে তদ্রƒপ প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি পরিবারের একটি হাহাকার, আর্তচিৎকার এবং আহাজারি থাকে। বিশেষ করে কেউ যদি কারও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অথবা আল্লাহপ্রদত্ত ক্ষমতা, পদপদবির বড়াই করে মানুষের ইজ্জত-আবরু, বসবাসের স্থান অথবা কর্মসংস্থান ধ্বংসের জন্য উন্মাদনা শুরু করে তখন স্বয়ং আল্লাহ মজলুমের পক্ষে দাঁড়িয়ে যান, যদিও মজলুম হয়তো এককালে জালেম ছিল এবং তার জুলুমের ফলে নয়া জুলুম অনিবার্য হয়ে পড়েছে তবু নয়া জুলুমকারীরা দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর অভিশাপ থেকে রক্ষা পায় না।

প্রকৃতির আইন অনুযায়ী জালিমের পতনই মজলুমদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। দ্বিতীয়ত, মজলুমকে যদি ক্ষমতা দেওয়া হয় তবে তা জালিমের জন্য সবচেয়ে বড় লজ্জা-অপমান-মনঃকষ্ট ও শাস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ক্ষমতা লাভের পর মজলুম যদি জালিমের মতো আচরণ শুরু করে তবে প্রকৃতির আইন নয়া জালিমের বিরুদ্ধে এবং সাবেক জালিম তথা নয়া মজলুমের পক্ষে চলে যায়। মানবজাতির হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে প্রকৃতির উল্লিখিত আইন কোনো রকম ব্যত্যয় ছাড়া অক্ষরে অক্ষরে জমিনের বুকে মাইলফলক তৈরি করে রেখেছে। কিন্তু আফসোস আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিইনি।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সূত্র : বিডিপ্রতিদিন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়