শিরোনাম
◈ দেখা গেছে শাবান মাসের চাঁদ, আরব আমিরাতে রোজা হবে ৩০টি ◈ ‘যে ৪ শর্তে ফিরতে পারবে আ.লীগ’ ◈ সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান গ্রেপ্তার ◈ বাংলাদেশে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে জাপান : ড. ইউনূস ◈ বাংলাদেশে বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে ট্রাম্পের ব্যবসায়িক অংশীদার জেনন্ট্রি বিচ (ভিডিও) ◈ নির্বাচনের বিকল্প নেই, এরসঙ্গে কম্প্রোমাইজ নেই: তারেক রহমান (ভিডিও) ◈ শেভরনের প্রস্তাব নাকচ করেছে বাংলাদেশ ◈ ছাত্ররা দল গঠন করবে, এটা দরকার :ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে ড. ইউনূস: ◈ কোচের বিরুদ্ধে বডি শেমিংয়ের লিখিত অভিযোগ নারী ফুটবলারদের, গণ-অবসরের হুমকি (ভিডিও) ◈ পদত্যাগ ও নতুন দল গঠন ইস্যুতে যা বললেন উপদেষ্টা নাহিদ (ভিডিও)

প্রকাশিত : ৩০ জানুয়ারী, ২০২৫, ১২:০৪ দুপুর
আপডেট : ৩১ জানুয়ারী, ২০২৫, ১২:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

'তৌহিদী জনতা' নামে হামলা করছে কারা?

বিবিসি নিউজ বাংলা: 'তৌহিদী জনতা' তথা 'বিক্ষুব্ধ মুসল্লিদের' দাবির মুখে বাংলাদেশের দিনাজপুর ও জয়পুরহাটে নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দেওয়া হয় সম্প্রতি। বিষয়টা শুধু খেলা বন্ধতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। খেলাকে কেন্দ্র করে এক জেলায় তৌহিদী জনতা ও আয়োজকদের মধ্যে সংঘর্ষও হয়।

অপর জেলায় নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করতে মাঠে হামলা করা হয় এবং মাঠের চারপাশে দেওয়া টিনের বেড়া ভাঙচুর করা হয়।

এই দুটো ঘটনাতেই কয়েকটি ইসলামপন্থী দলের নেতা-কর্মীদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় প্রশাসন।

বুধবার ঢাকাতেই 'মুসল্লি'দের চাপে চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাসের একটি অনুষ্ঠান তাকে ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয়েছে।

মূলত, গত পাঁচই অগাস্টের পর দেখা যাচ্ছে যে তৌহিদী জনতা বা বিক্ষুব্ধ মুসল্লিদের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই এরকম ঘটনা ঘটছে। তার মাঝে কখনও আছে বিভিন্ন নারীকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান পণ্ড করা, কখনও বা মাজারে ভাঙচুর।

ক্ষমতা গ্রহণের ছয় মাস হতে যাওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে যদিও বলা হয়েছে এসব ঘটনা মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।

কিন্তু দৃশ্যত তার কোনো প্রমাণ মিলছে না। বরং, এ ধরনের 'মবের' ঘটনা ঘটেই চলেছে। প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, এ ধরনের হামলায় আসলে জড়িত কারা? কেন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

ফিরে দেখা সাম্প্রতিক সময়

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অন্তত ১০টি স্থানে 'বিক্ষুব্ধ জনতার' হামলার ঘটনা ঘটেছে। তার মাঝে বিবিসি বাংলা চারটি ঘটনা যাচাই করে দেখেছে, এসব ঘটনার সাথে জড়িত অনেকের একটি সাধারণ পরিচয় হলো– হয় তারা ইসলামিক রাজনীতির সাথে জড়িত, অথবা ইসলামি রাজনীতির সমর্থক।

জয়পুরহাটের ঘটনার বিষয়ে জানা যায়, এই জেলার আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে বুধবার নারীদের ফুটবল ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু সেই খেলা বন্ধ করতে তার আগের দিন মঙ্গলবার বিকালে এলাকার 'বিক্ষুব্ধ মুসল্লিরা' জড়ো হয়ে মাঠের চারপাশের টিনের বেড়া ভাঙচুর করে বলে জানায় স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসন।

সেই ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে একজনকে বলতে শোনা যায়, "মুসলমান মেয়েদের ঘরে রাখার জন্য আল্লাহ তা'আলা বলেছেন। তারা পর্দার মধ্যে থাকবেন। সেই মেয়েদের এনে লেলিয়ে দিয়ে যুবকদের পাপাচার কাজে অগ্রসর করছে। মেয়েদের লেলিয়ে দেওয়া কীভাবে মানতে পারি! যারা মেয়েদের লেলিয়ে দিয়ে অর্থ উপার্জন করতে চান, আমি তাদের সতর্ক করতে চাই। আপনারা সাবধান হন।"

ওই ব্যক্তি তার বক্তব্যে আগামী দিনে মেয়েদের খেলা বন্ধ করারও আহ্বান জানান।

কারা, কখন, কী কারণে এই ঘটনা ঘটালো জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনজুরুল আলম বিবিসিকে জানান, "আছর নামাজের পর তারা আক্রমণ করে।"

"এরা সম্ভবত মাদ্রাসার ছাত্র এবং মুসল্লি," তিনি আরও যোগ করেন।

সঙ্গে এটাও জানান, "আগে থেকেই তাদের মাঝে অসন্তোষ ছিল...। প্রমীলা ফুটবল তো বাংলাদেশ থেকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। তাহলে কেন এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলো, সে ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না।"

একই দিনে দিনাজপুরের হাকিমপুরের হিলিতেও নারী ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করাকে কেন্দ্র করে 'তৌহিদী জনতা' ও আয়োজকদের মাঝে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে কয়েকজন আহতও হয়েছেন।

হাকিমপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অমিত রায় ও হাকিমপুর থানার ওসি সুজন মিঞা, দু'জনেই বিবিসিকে জানান, 'তৌহিদী জনতার' পরিচয় ব্যবহার করে সেখানে এই ঘটনা ঘটানো হয়।

স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে কথা বলা জানা যায়, স্থানীয় যুবসমাজের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নারীদের ফুটবল খেলাকে মেনে নিতে পারছিলেন না একটি পক্ষ।

আক্কেলপুর ও হাকিমপুর, এই দুই এলাকার ঘটনাতেই এখনও কোনো থানায় কোনো অভিযোগ জমা পড়েনি বলে জানিয়েছে স্থানীয় পুলিশ।

বুধবার ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে একটি রেস্টুরেন্ট উদ্বোধনের কথা ছিল চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাসের। রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ প্রচারণা শুরু করলে 'মুসল্লিরা' আপত্তি জানান। অপু বিশ্বাসকে উদ্বোধনের জন্য আনা হলে বিশৃঙ্খলা হবে বলে পুলিশকে জানান তারা।

কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি মো. আমিরুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে জানান, "আমি ফেসবুকে এরধরনের লেখালেখির স্ক্রিনশটও পেয়েছি। এ বিষয়টা ডিসি স্যারের কাছেও জানানো হয়। আমার কাছে রেস্টুরেন্ট মালিকেরাও আসেন।"

পরে রেস্টুরেন্ট মালিকদের সম্মতিতে অপু বিশ্বাসকে ছাড়াই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনার আরেকটি হলো হেফাজতে ইসলামের হুমকির মুখে টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলায় একটি প্রসাধন কোম্পানির বিক্রয়কেন্দ্র উদ্বোধনের অনুষ্ঠান স্থগিতের ঘোষণা। সেটি উদ্বোধন করার কথা ছিল অভিনেত্রী পরীমনির।

এর দু'মাস আগে, অর্থাৎ গত বছরের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চট্টগ্রামে শোরুম উদ্বোধন করতে গিয়ে একই ঢঙে 'তৌহিদী জনতার' বাধার মুখে পড়েছিলেন অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরীও।

এসবের বাইরেও দেশে নানা ধরনের মবের ঘটনা ঘটছে। যেমন– ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর গত ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৮০টির বেশি মাজার ও দরবারে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করার অভিযোগ করেছে বিশ্ব সূফী সংস্থা নামে একটি সংগঠন।

তৌহিদী জনতা আসলে কারা?

বিক্ষুব্ধ মুসল্লি, বিশেষ করে তৌহিদী জনতার নামে বারবার এই ঘটনাগুলো ঘটছে। দিনাজপুরের হাকিমপুরের ঘটনায় সেখানকার প্রশাসন সরাসরি-ই বলেছে, তৌহিদী জনতা সেখানে বিক্ষোভ করেছে। কিন্তু এই তৌহিদী জনতা কি নির্দিষ্ট কোনো দলের সদস্য বা সমর্থক?

এই প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর কেউ দিতে পারেননি।

অর্থাৎ, সাধারণভাবে তাদের কোনো দলীয় পরিচয়ে সজ্ঞায়িত করা যাচ্ছে না। তবে স্থানীয় সাংবাদিক ও প্রশাসনের বক্তব্যে একটি বিষয় স্পষ্ট যে এই তৌহিদী জনতা বিভিন্ন ইসলামভিত্তিক দলগুলোর সদস্য, কর্মী বা সমর্থক।

দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অমিত রায় বলেছেন, "গতকাল বিক্ষোভকারীরা তৌহিদী জনতার ব্যানারে এসেছিলো...তাদের রাজনৈতিক পরিচয় জানি না।"

এ প্রসঙ্গে হাকিমপুর থানার ওসি সুজন মিঞা বলেন, গতকাল সেখানে কয়েক শত "তৌহিদী জনতা মাঠের পাশে অবস্থান নিছিলো।"

তবে তারা কারা?

এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, "সকলেই আসছিলো। এর মাঝে মামুনুল হক সাহেবের খেলাফত মজলিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত নুরূল হক, তার নেতৃত্বেই হয়েছিলো। তবে এখানে কেউ একক কোনো রাজনৈতিক দলের না। সবাই তো কম-বেশি। ঘটনার পরে জুবায়েরপন্থী বাবলু হাজী আসছিলো।"

"ইসলামিক দল ও সংগঠনের সদস্য যেমন আছে, স্থানীয় মুসল্লিও আছেন," তিনি বলেন।

দিনাজপুরের মতো জয়পুরহাটের ঘটনার বেলায় প্রশাসনের তরফ থেকে সরাসরি 'তৌহিদী জনতার ব্যানারে' কথাটা উল্লেখ করা হয়নি। তবে আক্কেলপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিছুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, "এখানে বিভিন্ন গ্রুপের লোকজন আছে। তৌহিদী জনগণ আছে, সাধারণ লোকজন আছে। মহিলাদের খেলা, তারা চাচ্ছিলো না খেলাটা হোক।"

"আমাদের কাছে এখনও কেউ কোনো অভিযোগ দেয়নি। তবে আমরা যতটুকু জানতে পারছি, রাজনৈতিক লোকজনও আছে। এটায় চরমোনাই গ্রুপের আছে, জামায়াত ইসলামেরও আছে। বা স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মুসলিমরাও আছেন," যোগ করেন তিনি।

তার বর্ণনায়, গতকালের ঘটনায় "ইসলামিক দলগুলোর কর্মী, সমর্থকরাই" ছিল।

যদিও জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মঞ্জুরুল আলম এই বিক্ষোভকারীদের বর্ণনায় 'মাদ্রাসার ছাত্র' এবং 'মুসল্লি' শব্দ ব্যবহার করেছেন।

বারবার এসব হামলা কেন?

দেশে গত কয়েকমাস ধরে যে ধরনের মব সংস্কৃতি চলছে, তাতে অবধারিতভাবেই সমাজের অনেকেই সরকারকে দোষারোপ করছেন।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা এ প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলাকে বলেন, "যে কাজগুলো হচ্ছে, তা বেআইনি। সরকারের দায়িত্ব বর্তায় মব থামানোর।"

"যে সমস্ত বিষয়ে অন্য মতামত আছে, সেগুলো নির্ধারণ করার জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা আছে। কিন্তু প্রকাশ্যে এভাবে এখনও আইন ভাঙ্গা, এটা 'রঙ সিগন্যাল' দেবে। এতে আইনের অবনতি তো হবেই, অথরিটির প্রতি থাকা ভয় চলে যাবে। ভয় চলে গেলে শাসন করা মুশকিল হয়ে যাবে।"

তিনি এও মনে করেন, এই সমস্যা মোকাবিলার ব্যাপারে "সরকারের শৈথিল্য আছে।"

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক সাইয়েদ আব্দুল্লাহ আল মারুফ মনে করেন, সরকারকে স্পষ্ট করতে হবে যে তারা কী চায়।

দেশে বর্তমানে যে ধরনের মব সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা চলতে থাকলে "দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নষ্ট হবে। ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। কেউ সামাল দিতে পারবে না," বলেন তিনি।

"সেজন্য দেশ আরও খারাপের দিকে যাওয়ার আগে বর্তমান সরকারকে এটা প্রমাণ করতে হবে যে তারা কী চায়। এই মব দমন না করলে এটা ঠিক করতে কত বছর লাগবে কেউ জানে না।"

এছাড়া, কিছু হলেই তৌহিদী জনতার ব্যানারে বিভিন্ন খাতে হস্তক্ষেপের বিষয়ে অধ্যাপক মারুফ বলেন, "তারা যা করছে, ইসলাম, রাষ্ট্র বা আইন তাদেরকে সেই অনুমতি দেয় না।"

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক শামসুল আলমও বলেছেন, "ইসলাম নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে। তৌহিদী জনতার নাম করে এগুলো করা ইসলাম সম্মত না।"

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়