দেনমোহর হচ্ছে প্রত্যেক বিবাহিত মুসলিম নারীর আইনগত অধিকার যা পুরুষ কর্তৃক পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক। অন্য ভাষায় বলা যায়, দেনমোহর হচ্ছে স্ত্রীর নিকট স্বামীর জামানতবিহীন ঋণ যা পরিশোধ করা শুধু কর্তব্যই না বরং বাধ্যতামূলক। আমাদের দেশে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলগুলোতে দেনমোহর নিয়ে ধোঁয়াশা দেখা যায়।
অনেকেই মনে করেন যে, শুধুমাত্র তালাকের মাধ্যমে বিবাহিত জীবনের ইতি ঘটলেই দেনমোহর পরিশোধ করতে হয়। আসলে, তালাকের সাথে দেনমোহর পরিশোধের কোন সম্পর্ক নেই। তালাক হোক বা না হোক, দেনমোহর পরিশোধ করতেই হবে।
দেনমোহরের প্রকারভেদ : মুসলিম শরীয়াহ আইন অনুযায়ী, দেনমোহর দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে মুয়াজ্জল বা আশু দেনমোহর যা স্ত্রী দাবী করা মাত্র স্বামী পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবে। মুয়াজ্জল দেনমোহর আবার তাৎক্ষণিক দেনমোহর হিসেবেও পরিচিত।
আরেক ধরনের দেনমোহর হচ্ছে মুঅজ্জল বা বিলম্বিত দেনমোহর। এ দেনমোহর শুধুমাত্র তালাক বা স্বামীর মৃত্যুর মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে দাবী করা যায়। অন্যথায়, মুঅজ্জল দেনমোহর দাবী করা যায় না।
দেনমোহর কখন নির্ধারণ করতে হয় : দেনমোহর বিবাহের সময়, পূর্বে বা পরে যে কোন সময় নির্ধারণ করা যায়। এক্ষেত্রে কোন ধরা বাঁধা নিয়ম নেই। তবে দেনমোহর ব্যতীত কোন বিবাহ সম্পন্ন হতে পারে না। স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় দেনমোহর মাফ করে দেন তবে সেটা ব্যতিক্রম বিষয়। অন্যথায়, দেনমোহরের অস্তিত্ব বাধ্যতামূলক।
দেনমোহর নির্ধারণের পদ্ধতি : দেনমোহর নির্ধারণের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় লক্ষ্য রাখতে হয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে দেখা হয় যে, মেয়ের পরিবারের অন্যান্য মহিলা সদস্য যেমন বোন, খালা, ফুফু তাদের ক্ষেত্রে কি পরিমাণ দেনমোহর ধার্য করা হয়েছিল। তাছাড়া মেয়ের পরিবারের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান বিবেচনায় নেয়া হয়। এর পাশাপাশি স্বামীর আর্থিক সামর্থ্যের বিষয়টিও দেখা হয়।
দেনমোহরের পরিমাণ: মুসলিম আইনের বিধান অনুযায়ী, দেনমোহরের পরিমাণ কম পক্ষে ১০ দিরহাম হতে হবে যা বাংলাদেশের টাকার হিসাবে ২৩০ টাকার সমান। দেনমোহরের সর্বোচ্চ পরিমাণ সম্পর্কে আইনে উল্লেখ নেই। অর্থাৎ, সর্বনিম্ন ২৩০ টাকা থেকে শুরু করে যে কোন পরিমাণ অর্থ দেনমোহর হিসেবে নির্ধারণ করা যাবে।
দেনমোহর নির্ধারিত না হলে করণীয় : বিবাহের ক্ষেত্রে দেনমোহর বাধ্যতামূলক হলেও অনেক সময় দেখা যায় যে, কোন বিশেষ কারণে বা সময় ও সুযোগের সল্পতার কারণে দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে মেয়ের বোন, খালা ফুফুদের দেনমোহরের পরিমাণ ও মেয়ের পরিবারের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে উপযুক্ত দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে।
নগদ অর্থ ব্যতীত অন্য কোন উপহার দেনমোহর হিসেবে বিবেচিত হয় কি না
অনেক সময় দেখা যায় যে, নগদ অর্থের পরিবর্তে সোনার গয়না কিংবা জমি প্রদান করার মাধ্যমে দেনমোহর পরিশোধ করা হয়। এক্ষেত্রে অবশ্যই একটি দলিল তৈরি করে সেখানে ‘দেনমোহর বাবদ’ কথাটি উল্লেখ করতে হবে। অন্যথায়, গয়না বা জমির মূল্য যদি নির্ধারিত দেনমোহরের চেয়ে বেশিও হয়, তবুও সেটা পরিশোধিত দেনমোহর বলে গণ্য হবে না। উল্লেখ্য যে, বিয়ের নিছক উপহার যেমন, শাড়ি, গয়না এগুলো দেনমোহর নয়।
দেনমোহর দাবী করে না পেলে করণীয়
মুসলিম আইনে দেনমোহরের গুরুত্ব অপরিসীম। বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, দেনমোহর দাবী করে না পাওয়া গেলে স্ত্রী সংসার ছেড়ে অন্যত্র গমন করতে পারেন। এমনকি সেক্ষেত্রে স্বামী কর্তৃক দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের মামলা হলেও তা খারিজ হবে। এখানে আরেকটি বিষয় হচ্ছে যে, দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের ডিক্রি না পেলেও স্বামী স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য থাকবেন।
দাবীকৃত দেনমোহর না পেলে আরেকটি পথ অনুসরণ করা যায়। আর তা হল পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করা। একজন আইনজীবীর মাধ্যমে পারিবারিক আদালতে আরজি দাখিলের মাধ্যমে মামলাটি দায়ের করতে হয়। মামলার ক্ষেত্রে দেনমোহরের কোন অংশ মুয়াজ্জল আর কোন অংশ মুঅজ্জল তা আদালতে উপস্থাপন করা আবশ্যক।
এ বিষয়ে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ এর ১০ ধারায় বলা হয়েছে যে, কাবিননামায় এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ না থাকলে দেনমোহরের সম্পূর্ণ অংশই মুয়াজ্জল হিসেবে ধরে নেয়া হবে এবং বিবাদী তা পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবে। দেনমোহরের একটি মামলায় আদালত বক্তব্য প্রদান করেন যে, নির্ধারিত দেনমোহরের পরিমাণ অত্যাধিক অথবা স্বামীর সামর্থ্যের বাইরে এ ধরনের কোন ব্যাখ্যা দেয়া যাবে না।
দেনমোহরের একটি মামলা : দেনমোহরের এক মামলার ঘটনা অনুযায়ী, একজন স্বামী তার স্ত্রীকে দেনমোহর বাবদ ৫ বিঘা জমি প্রদান করেন। পরবর্তীতে, স্বামী মত প্রদান করেন যে, সেই ৫ বিঘা জমি বিক্রয় করে অন্য জায়গায় ১৩ বিঘা জমি ক্রয় করে সেখান থেকে ৫ বিঘা জমি স্ত্রীকে ফেরত দিবেন। কিন্তু স্বামী জমির উক্ত অংশ ফেরত না দেয়ায় স্ত্রী মামলা করেন।
আদালত স্ত্রীর পক্ষে এ মর্মে রায় দেন যে, স্বামী তার ক্রয়কৃত ১৩ বিঘা জমি থেকে ৫ বিঘা জমি স্ত্রীকে ফেরত দিবেন। অত:পর স্বামী উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে আপিল দায়ের করেন। মহামান্য হাইকোর্ট আপিলে নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখেন।
দেনমোহর পরিশোধের পূর্বে স্বামী বা স্ত্রীর মৃত্যু হলে করণীয় : দেনমোহর পরিশোধ ব্যতীত স্বামীর মৃত্যু হবার মত ঘটনা ঘটতেই পারে। এক্ষেত্রে স্ত্রী তার মৃত স্বামীর উত্তরাধিকারগণের নিকট দেনমোহর দাবী করতে পারেন। উত্তরাধিকারগণ ব্যক্তিগতভাবে দেনমোহর পরিশোধ করতে বাধ্য নন। তবে মৃত ব্যক্তির স্ত্রী দাবী করলে তা পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক। কারণ এটা সেই স্ত্রীর অধিকার।
একইভাবে, স্বামীর পূর্বে যদি স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেন এবং উক্ত স্ত্রীর দেনমোহর অপরিশোধিত থাকে, তাহলে স্ত্রীর উত্তরাধিকারগণ স্বামীর নিকট দেনমোহর দাবী করতে পারবেন। এমনকি এ বিষয়ে প্রয়োজনে উত্তরাধিকারগণ স্বামীর বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করতে পারবেন।
শেষ কথা : পরিশেষে বলা যায় যে, ইসলাম দেনমোহর প্রথার মাধ্যমে নারীদেরকে বিশেষ সম্মান প্রদান করেছে। এটি নারীদের একটি আইনী অধিকার যা রক্ষা করা অবশ্য কর্তব্য। বিবাহের বিভিন্ন শর্তের মধ্যে দেনমোহর অন্যতম। লেখক: অ্যাডভোকেট নাজিয়া আমিন, আইনজীবী, জজ কোর্ট, ঢাকা। উৎস: ল'ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ
আপনার মতামত লিখুন :