ডা. রুমি আহমেদ খান এর ফেসবুক থেকে.......
৯৪ বছর একটিভ লাইফ আসলেই রেয়ার এবং বি চৌধুরী স্যার ৯৪ বছর পর্যন্তই মোটামুটি কর্মক্ষমই ছিলেন। তারপরও উনি যাবার জন্যে রেডি ই ছিলেন এবং যখন ওনার ডাক এসেছে - উনি যে কোন মূল্যে এই পৃথিবীর মাটি ঘেঁষে পরে থাকার চেষ্টা করেন নি।
আমি ওনার অসুখের ডিটেইল জানি না। ধরে নিলাম বার্ধক্য জনিত রোগ। যখন অসুস্থ হলেন - উনি কি করেছেন আর কি করেন নি তার একটা লিস্ট দেই আপনাদের।
১. উনি ভর্তি হয়েছে নিজের তৈরী হাসপাতাল - উত্তরা মহিলা মেডিকেল কলেজ।
২. উনার চিকিৎসার দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওনার স্টুডেন্ট দের - যাঁদের কে উনি মেডিসিন শিখিয়েছেন। কোন মেডিকেল বোর্ড, ধানাই পানাই নেই।
৩. উনি প্রথমেই একটা ব্যাপার ক্লিয়ার করে দিয়েছেন ওনার চিকিৎসকদের - বাবারা আমার বয়েস ৯৪। এখন আমার যাবার সময়। তোমরা আমার কমফোর্ট এনসিউর করো। কোন সার্জারি, ডেইলি খোঁচা খুঁচি, একগাদা ঔষধ কিছু লাগবে না। অক্সিজেন যদি আমাকে কমফোর্ট দেয় - শুধুই অক্সিজেন দাও। আমি আমার জীবন যাপন করেছি পরিপূর্ন ভাবে। আল্লা আমাকে যদি আয়ু আরো দেন দেবেন, ওই কয়টা দিন যাতে একটু কম্ফোর্টেবল থাকতে পারি - এই বয়সে এসে একদিন দেশি বাঁচার জন্যে সারা দুনিয়ার বিনিময়ে যমের সাথে রেসলিং করার আগ্রহ আমার নেই।
৪. ওনার কমফোর্ট নিশ্চিত করা হয়েছে। উনি নামাজ কালাম পড়েছেন। উনি রবীন্দ্র সংগীত পছন্দ করতেন - তরুণ চিকিৎসকরা ওনার পছন্দের কাজ গুলোই করেছেন যখন উনি যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছিলেন। এই একই কাজ টা পশ্চিমা দেশের অধিকাংশ রুগীই করেন।
এবার বলি উনি কি করেন নি -
১. উনি সিএমএইচ এ পাঠানোর জন্যে বায়না ধরেন নি। নিজের হাতে গড়া চিকিৎসক ও হাসপাতালের উপর আস্থা রেখেছেন।
২. দুনিয়ার সব ডাক্তার ডেকে এনে দৈনিক মেডিকেল বোর্ড এর মতো একটা সার্কাস এর সাবজেক্ট করেন নি নিজেকে।
৩. কর্পোরেট হাসপাতালে গিয়ে আশ্রয় নেন নি।
৪. এয়ার এম্বুলেন্স এ করে ব্যাংকক / সিঙ্গাপুর যাওয়ার বায়না ধরেন নি।
৫. পই পই করে বলে দিয়েছেন - না। ভেন্টিলেশন না। আইসিইউ বেডে হাত বাধা অবস্থায় - শরীরের সবগুলো ওপেনিং এ একটা করে টিউব ঢোকানো অবস্থায় না। মৃত্যু টা যেন হয় - মর্যাদার সাথে - পিসফুলি।।
------
মানুষের অর্থব্যয় এর ক্ষমতা বাড়ার সাথে সাথে - আর চিকিৎসা ব্যবস্থার কর্পোরেটাইজেশনের সাথে সাথে বাড়ছে ব্যয় সাপেক্ষ চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থা। বাংলাদেশে হাসপাতাল গুলো আজ আইসিইউ এর ব্যাপারে বেশ আগ্রহী। বড় শহর গুলো তে তো বটেই, জেলা এমন কি উপজেলা পর্যায়ের বেসরকারি হাসপাতাল গুলোতেও আজকাল আইসিইউ খোলা হচ্ছে।
এই আইসিইউ গুলো চালানোর পর্যাপ্ত লোকবল আমাদের যে নেই তাতে কোন প্রশ্নের অবকাশ নেই। তবে এর সাথে ওতপ্রেত ভাবে জড়িত আছে আরেকটি ব্যাপার। আমাদের চিকিৎসক সমাজ এন্ড অফ লাইফ হ্যান্ডেল করায় নিজেদের অভিজ্ঞতার অভাবে, রুগীর চাপে, পরিবারের চাপে অথবা সমাজের চাপে রুগীকে আইসিইউতে ভর্তির উপদেশ দিয়ে থাকেন যা অনেক ক্ষেত্রেই এপ্রোপ্রিয়েট না।
আইসিইউ চিকিৎসা খরচ অনেক বেশি - এবং অনেক ক্ষেত্রে আইসিইউ তে চিকিৎসা দিয়ে প্রচুর অর্থব্যয় ছাড়া আউটকাম এর কোন পরিবর্তন হয় না। একবার বা দুবার না - অন্তত একশো বার বাংলাদেশে এই ঘটনার রিপিট হতে দেখেছি। একজন নব্বই উর্ধ প্রপিতামহ অসুস্থ হয়ে জীবনের শেষ একটা মাস হাসপাতালে কাটালেন - মৃত্যু পর্যন্ত।
ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত প্রপিতামহ জানলেন কিংবা বুঝলেন কিনা জানি না যে তার ভালো চিকিৎসা হল আইসিঊ তে। কিন্তু তার ভালো চিকিৎসা দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য পুরো পরিবারটা অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু হয়ে গেলো। এই লক্ষ লক্ষ টাকা হাসপাতালের বিল দিয়ে হয়তো এই পরিবারের কোন তরুণ একটা ব্যবসা ভেঞ্চার খুলতে পারতো - অথবা কেউ বিদেশে পড়তে যেতে পারতো।
আর আইসিইউ র লিমিটেড বেড আর রিসোর্স গুলো দখল হয়ে থাকল একজনের জন্য যার জীবন এমনিতেই শেষ প্রান্তে - ডিমেনশিয়া আর নানাবিধ রোগে শয্যাশায়ী বছরের পর বছর ধরে। আইসিইউ লিমিটেড রিসোর্স টা ব্যবহার করা যেত একজন বিশ বছর বয়সী তরুণ রুগীর জন্য।
তবে আইসিইউ ট্রায়াজ কালচার টা ডেভেলপ করা বলা যত সহজ করা তত সহজ না - এই কালচার চেঞ্জ আসতে হবে ডাক্তার দের মাঝে, রুগীদের মাঝে আর সমাজে।
পঁচাশি বছর বয়সী পিতামহ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন - তাকে কি ভেন্টিলেটরে দেবেন? উনি কি ভেন্টিলেটর থেকে মুক্তি পাবেন কখনো? নাকি বাকি কটা দিন আইসিইউ তে বেডের সাথে হাত বাধা অবস্থায় ভেন্টিলেটরের মতো একটা অমানবিক পেইনফুল সিষ্টেমের সাথে আটকিয়ে থেকে কাটাবেন?
কিন্তু ভেন্টিলেটরে না দিলে হয়তো আজই মৃত্যু হবে পিতামহর - ভেন্টিলেটরে না দেয়ার খুব কঠিন সিদ্ধান্ত - এই ধরণের সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য যে কালচারাল দক্ষতা - তা রুগীর মাঝে আসতে হবে, চিকিত্সকের মাঝে আসতে হবে, আর সমাজে আসতে হবে।
আমাদের সমাজে অনেক ক্ষেত্রেই অনেক পরিবির্তন হয়েছে - এক্ষেত্রেও নিশ্চয় ই হবে। আমি আশাবাদী খুব বেশিদিন লাগবে না। মৃত্যটা বাড়িতে - পরিবার পরিজন বেষ্টিত হয়ে নিজের বিছানায় হওয়াটাই কি বাঞ্চনীয় না??
ডাঃ বি চৌধুরীর চেয়ে ভালো বুঝবে কে - কোনটা বাঞ্চনীয় আর কোনটা না!
আরেকজন এই কাজ করেছেন কিছুদিন আগে - ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী। নিজের হাসপাতাল ছেড়ে বিদেশ মুখী হন নি। লাইফ সাপোর্টেও থাকতে চান নি।
এই উইজডম টা ডাঃ বি চৌধুরী বা ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ছিল।
অধ্যাপক বি চৌধুরী অনেক উচ্চ শিক্ষিত - উঁচু পরিবারের - উচ্চ রুচির মানুষ। নিজের লাস্ট এক্ট দিয়ে দেশবাসীর জন্যে উনি একটা রোল মডেল দিয়ে গেলেন।
এই দুইজন হচ্ছেন আমাদের ন্যাশনাল হিরো। এঁরা আমাদের সামনে যে উদাহরণ তৈরী করে গেলেন - জাতিগত ভাবে তা আমরা কি ফলো করতে পারবো? ফলো করবো? নাকি চিরাচরিত প্রথায় ব্যাংকক থেকে কাঠের বাক্সে করে দেশে ফিরবো??
ওঁনাদের এই লাস্ট এক্ট গুলো কি আমাদের এই ব্যয়বহুল জাতিগত স্বভাব কালচার এ কিছুটা হলেও পরিবর্তন আনতে পারবে???
© রুমি আহমেদ খান। এমডি, এফসিসিপি।
ইন্টারনাল মেডিসিন, ক্রিটিকাল কেয়ার, পালমোনারি, নিউরোক্রিটিকাল কেয়ার ও প্যালিয়েটিভ কেয়ার বোর্ড সার্টিফায়েড ও বিশেষজ্ঞ।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস অস্টিন এর অধ্যাপক।
আপনার মতামত লিখুন :