মহসীন কবির: সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত, ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ শনাক্ত, প্রতিরোধ, দমন ও এই অপরাধের বিচার এবং আনুতোষিক বিষয়ে নতুন বিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে জাতীয় সংসদে ২০২৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ‘সাইবার নিরাপত্তা বিল-২০২৩’ সংসদে পাস হয়। এরপর থেকে এ আইন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। সমাজের নানা স্থর থেকে এ আইনটি বাতিল করার জন্য বলা হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার কর্নপাত করেনি।
এর আগে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে (ডিএসএ) করা মামলায় পাঁচ বছরে সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত হয়েছেন রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক। আর অভিযোগকারীদের মধ্যে ক্ষমতাসীন রাজনীতির সঙ্গে যুক্তরা শীর্ষে আছেন। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ২০২১ সালে।
পাঁচ বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় ৪ হাজার ৫২০ জন অভিযুক্ত এবং ১ হাজার ৫৪৯ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ সময় মাসে গড়ে মামলা হয়েছে প্রায় ২৪টি এবং গ্রেপ্তার হয়েছে প্রায় ২৬ জন।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বাক্স্বাধীনতা চর্চার জন্য মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষার্থীসহ বহু মানুষকে সাইবার নিরাপত্তা আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে দায়েরকৃত মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেই ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত আনুমানিক ১ হাজার ৪৩৬টি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় ৫ হাজার ২৮৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।
ঢাকাভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে সাইবার নিরাপত্তা আইন কার্যকর হওয়ার পর এ আইনে অন্তত ৬২টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৩৭২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।
জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সন্ত্রাস দমন আইন ও ডিজিটাল বা সাইবার নিরাপত্তা আইনে দায়েরকৃত মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হচ্ছে।
৩ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, সাইবার নিরাপত্তা আইন অবশ্যই বাতিল করা উচিত। শুধু সাইবার নিরাপত্তা আইন নয়, পর্যায়ক্রমে সব কালো আইন বাতিল করা হবে। আমরা সাইবার আইনটি নিয়ে আরও মতামত নেব। প্রয়োজনে সাইবার সুরক্ষা দিতে নতুন আইন করা হবে। বিশেষ করে নারীদের সুরক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে কাজ করবে এটি। তিনি আরও বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া ‘স্পিচ অফেন্স’ (মুক্তমত প্রকাশ) সম্পর্কিত মামলাগুলো সরকার দ্রুত প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব মামলায় কেউ গ্রেপ্তার থাকলে তিনিও আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুক্তি পাবেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্বতনমূলক আইন হিসেবে পরিচিত সাইবার নিরাপত্তা আইন সংশোধন নয়, পুরোপুরি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার অংশীজনসহ আইনজ্ঞরা। তাঁদের মতে, সাইবার নিরাপত্তার জন্য আইন করা হলেও অতীতে এটি ব্যবহার করা হয়েছে রাজনৈতিক ভিন্নমত দমনে। আইনটি বাতিল করা উচিত। প্রয়োজন হলে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে সংবিধান অনুযায়ী ব্যক্তির সাইবার সুরক্ষা এবং ধর্ম ও নারীর অধিকারসংক্রান্ত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে নতুন আইন করা যেতে পারে।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইন মানুষের কাছে অনাস্থার জায়গা থেকেই যাবে। তাই আইন সংশোধন বা নাম রাখাকে সমর্থন করা যায় না। আইনের পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু পরিবর্তন বা সংশোধনের মাঝের সময়টুকুতে এটিকে স্থগিত বা কি করা যায় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যাতে করে এই আইনের আওতায় আর একটাও মামলা না হয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘পুরো আইন ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করায় সাইবার নিরাপত্তা আইনের নামও বাতিলের আহ্বান জানাই।’
প্যানেল আলোচনায় ভার্চুয়ালি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, সংশোধিত (প্রস্তাবিত) সাইবার নিরাপত্তা আইন থেকে মানহানি তুলে দেওয়ার বিষয়টিকে স্বাগত জানাই। দণ্ডবিধি থেকেও এটি তুলে দেওয়া উচিত। এছাড়া ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার যে বিষয়গুলো রয়েছে সেসব বিষয়ে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে অনুমোদন নেওয়ার একটি ব্যবস্থা থাকা উচিত। এ বিষয়টি বিবেচনা করা দরকার।
ঢাকা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক রিয়াজ আহমেদ বলেন, গ্রেপ্তার ও তল্লাশির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে সাইবার নিরাপত্তা আইনে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তা আরও নিয়ন্ত্রিত হওয়া দরকার। তদন্ত পর্যায় এমমনভাবে হওয়া উচিত যেটি জনগনের পক্ষে যাবে। তিনি আরও বলেন, যারা মামলা দায়ের করেন তারাও জানেন এই মামলায় আসামি বেকসুর খালাস পাবেন। কিন্তু তার উদ্দেশ্যে থাকে শুরুতেই যে কয়দিন খাটানো (কারাবাস) যায়। এই সিস্টেম থেকে বের হতে হবে। আইন দিয়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশে বাধা দেওয়া কাম্য নয়।
বাংলাদেশের ত্রুটিপূর্ণ সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ) বাতিল কিংবা সংস্কার করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সুপারিশ করেছে ‘আমেরিকান বার অ্যাসোসিয়েশন সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস’। একই সঙ্গে মানবাধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে সিএসএ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে (আইসিটি অ্যাক্ট) করা মামলাগুলো প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে তারা।
আইনজীবীদের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা আমেরিকান বার অ্যাসোসিয়েশন সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস ঝুঁকিতে থাকা আইনজীবীদের সহায়তা, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা এবং আইনের আওতায় সরকারি কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহি করানোর ক্ষেত্রে কাজ করে থাকে।
জাকিয়া শিশরি নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থেকে সাইবার নিরাপত্তা আইন! এটা এমনই এক ঘি যুক্ত খাবার যার লোভ কেউ ছাড়তে পারে না! বর্তমান দুইজন উপদেষ্টা এই মামলার আসামি, অথচ এই আইন বাতিল কিংবা সংশোধনের কোন ব্যবস্থা গ্রহন এখনও চোখে পড়ে নাই!
এই মামলার আসামিরাও খালাস পায় নাই উল্টা নতুন আসামি যুক্ত হচ্ছে এই মামলায়৷ যেই সরকার আসুক, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল না হলে লড়াইটা কিন্ত জারি থাকবে!
কিশোর পাশা নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল হচ্ছে। আগে এ ধারাই অথবা এর আগের এরকম অনুরূপ ধারায় যতগুলো মামলাতে হয়েছিল সবগুলো বাতিল ঘোষণা করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
আশা করি যাদেরকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার সাইবার মামলা দেওয়া হয়েছিল, সবাই মুক্তি পাবে। আশা করি আজকের পর থেকে আর কাউকে মোহাম্মদকে কটুক্তি করেছে বলে মামলা দেয়া যাবে না।
ফয়সাল আহমেদ নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, সাইবার নিরাপত্তা আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে নতুন হ্যাকিং প্রতিরোধী আইন নামে নতুন করেন।
নাঈম হাসান নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, বহুবার সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল চেয়েছিলাম লীগের আমলে। এইসব নিয়ে সাবেক মন্ত্রী মোস্তফা জব্বারের সাথে ইনবক্সে ক্যাচালও হয়েছিলো৷ অবশেষে সেই আইন বাতিল হচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ।
রাশিদ আমিনুর নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ড্রাকোনিয়ান সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল হচ্ছে। এতদিন লাগল আ ও য়া মী নির্যাতনের টুল বাতিল করতে!
হুঁশ যে ফিরেছে তার জন্য লাখো শুকরিয়া।
মেহেদি হাসান নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, কুখ্যাত কালো আইন তথা সাইবার নিরাপত্তা আইন এবং সন্ত্রাস বিরোধী আইন ছিল ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকার কর্তৃক জনগণকে দমন করার অন্যতম হাতিয়ার। যার নির্মম শিকার হয়েছিল অগণিত আলেম, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, নিষ্ঠাবান সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবিসহ প্রতিবাদী সাধারণ জনগণ। এসব আইনের আলোকেই "আয়না ঘর" প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাই প্রশ্ন হচ্ছে, এসব কালো আইন বহাল রেখে আদৌ কি যুলুম মুক্ত নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব?
আপনার মতামত লিখুন :